শামীম শিকদার
মতামত
সমন্বয়হীন পদক্ষেপ জলাবদ্ধতায়
রাজধানীতে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা যেন তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ সড়কই এখন সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায়। দীর্ঘ সময়ের জন্য তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। নাগরিকদের ভোগান্তি প্রতিনিয়তই বাড়ছে। অন্যদিকে জলাবদ্ধতার কারণে যানজট নগরবাসীকে জিম্মি করে ফেলছে। চলতি বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা বেশি হওয়ায় বারবার এ ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে নগরবাসীকে। এখনো বর্ষাকাল আসেনি। সামনে বর্ষা।
গত বছর জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি করপোরেশন প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি অত্যাধুনিক ‘জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন’ কিনেছে। বলা হয়েছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারে। প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না। জানা যায়, ঢাকার জলাবদ্ধতাপ্রবণ এসব এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য গত দুই বছরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো প্রায় হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। এ বছর সড়ক, ফুটপাত ও ড্রেন নির্মাণে ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরেছে ডিএসসিসি। এরই মধ্যে প্রায় সব টাকা খরচ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া ডিএনসিসি তাদের বার্ষিক বাজেটে এ খাতে প্রায় ২৭৮ কোটি বরাদ্দ রেখেছে। এরই মধ্যে সে টাকাও শেষ হওয়ার পথে। গত অর্থবছরে ডিএনসিসি নর্দমা ও ড্রেন নির্মাণে আরো ১৭৫ কোটি টাকা খরচ করে বলে জানা যায়। এ ছাড়া ডিএসসিসি তাদের একটি মেগা প্রকল্পের ১ হাজার ২০২ কোটি টাকা থেকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে কয়েক কোটি টাকা ড্রেন ও নর্দমা নির্মাণে ব্যয় করেছে। ঢাকা ওয়াসাও তাদের নিজস্ব ড্রেন পরিষ্কারের পেছনে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করেছে। এর পরও বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে না।
রাজধানীর গ্রিনরোড, শুক্রাবাদ, সোবাহানবাগ, ধানমন্ডি-২৭ নম্বর সড়ক, জিগাতলা, মিরপুর-১,২,১০,১২ নম্বর এলাকা, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, আগারগাঁও, তালতলা, শাহজাদপুর, আলাউদ্দিন রোড, মতিঝিল, দিলকুশা, আরামবাগ, খিলগাঁও, ফকিরাপুল এলাকার পাশাপাশি ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহাবাগ, মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলামোড়, পল্টন এলাকায় এলাকায় ‘এক দেড় ফুট’ পর্যন্ত পানি জমে।
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে জলাবদ্ধতা বেশি উত্তর সিটিতে। এর মধ্যে কারওয়ান বাজার, মিরপুর, কালশী, শ্যামলী, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকা অন্যতম। ঢাকার বেগুনবাড়ী, পান্থপথের বিভিন্ন এলাকা, ধানমন্ডি, কুড়িল, পুরান ঢাকার আলাউদ্দিন রোড, যাত্রাবাড়ী মোড়, জুরাইন, শহীদনগর, মধুবাগে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় অল্প বৃষ্টিতেই, অলিগলি হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। পূর্ব জুরাইন থেকে ডিএনডি বাঁধ পর্যন্ত এলাকায় বছরের প্রায় প্রতিদিনই পানি জমে থাকে। এই এলাকাটি অন্যান্য এলাকার তুলনায় অনেক নিচু হওয়ায় আশপাশের এলাকাসহ বাসাবাড়ির স্যুয়ারেজের পানি জমে জলাদ্ধতা দেখা দেয়।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০০৯ সাল থেকে গত নয় বছরে সরকারের চারটি সংস্থা মোট ১ হাজার ৯৯৬ কোটি খরচ করেছে। সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ না কারায় বিপুল অঙ্কের এই টাকা নর্দমা নির্মাণ ও মেরামত, পাম্পস্টেশন খাল-বক্স কালভার্ট খনন ও পরিষ্কার করার মতো ছোটখাটো কাজে ব্যয় হয়েছে। ফলে সাময়িক অসুবিধা দূর হলেও রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে এই টাকা কোনো কাজে লাগেনি। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির বেশ কয়েকটি কারণ থাকলেও তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি কারণ সরাসরি ভূমিকা রাখে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ : অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মহানগরীতে এখন প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস করছেন। তাদের জন্য শহরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাটসহ নানা অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে শহরের বেশির ভাগ এলাকার পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
সমন্বয়হীন সংস্কারকাজ : ঢাকা শহরে সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর উন্নয়নকাজে কোনো সমন্বয় না থাকায় সারা বছরই সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি চলতেই থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ওয়াসা স্যুয়ারেজ নির্মাণের জন্য একটি সড়ক খোঁড়া হলো, সে কাজ শেষ হতে না হতেই আবার খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করল গ্যাস কিংবা বিদ্যুৎ বিভাগ, ফলে সারা বছর সড়কগুলোয় এ ধরনের কাজ চলায় যার ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
পলিথিনের অবাধ ব্যবহার : পলিথিন ব্যবহার না করার আইন থাকলেও তার সামান্যটুকুও মানা হয় না দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মতো ঢাকা শহরেও। ফলে দুই কোটি মানুষের এই শহরে প্রতিদিন যে বর্জ্য তৈরি হয় তার অধিকাংশজুড়েই থাকে পলিথিন। এসব পলিথিন খুব সহজেই পানি নিষ্কাশনের পথগুলো বন্ধ করে দেয়।
যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা : ঢাকা শহরের অনেক এলাকাতেই এখনো ময়লা ফেলা হয় খোলা জায়গায়। এসব ময়লা-আবর্জনা, বিশেষ করে কঠিন বর্জ্যরে একটা অংশ সরাসরি ড্রেনে গিয়ে প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায় রাস্তাঘাটে।
খাল দখল : ঢাকা নগরীর ৬৫টি খাল একসময় এ মহানগরীর পানি নিষ্কাশনে বিশেষ ভূমিকা রাখত। কিন্তু রাজধানীর এই খালগুলো এখন খুঁজে পাওয়াও কঠিন। বেশির ভাগই চলে গেছে দখলদারদের হাতে। অনেকগুলো ভরাট করে ফেলা হয়েছে। যে দুয়েকটি টিকে আছে সেগুলোও দখলে জর্জরিত।
নদী ভরাট : ঢাকা শহরের চারপাশে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা প্রভৃতি নদীগুলো ক্রমান্বয়ে ভরাট করে ফেলেছে এক শ্রেণির প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা। আর তাই বিশাল জনসংখ্যার এ শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান পথ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। ড্রেনের ময়লা ড্রেনে : ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ড্রেন থেকে ময়লা তুলে সেগুলো দিনের পর দিন ড্রেনের পাশেই ফেলে রাখা হয়। ফলে বৃষ্টি হলেই সে ময়লার পুনরায় ঠিকানা হয় ড্রেন। যার ফলে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রকল্প বাস্তবায়নে সেবা সংস্তাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ঘাটতি কমিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সংস্থার মধ্যে কাজের সমন্বয় ঘটাতে হবে। দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পরিচর্যার বদলে ওয়াসার কর্তাব্যক্তিদের নিজেদের আখের গোছানোর কাজে বেশি ব্যস্ত না থেকে ওয়াসার দায়হীন ভূমিকা পালনে বিরত থাকতে হবে। ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে এবং নিষ্কাশন পাম্প চালু করে দায়িত্ব শেষ করার ট্রাডিশনে অভ্যস্ত না থেকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ঢাকার ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ২৭টি খাল ভূমিদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করে তার হারিয়ে যাওয়া যৌবনকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় কোনো কিছুতেই এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।
লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক