মো. আশরাফ হোসেন

  ০১ জুন, ২০১৮

অর্থনীতি

স্টক মার্কেট ও করব্যবস্থা

আনুষ্ঠানিক শিল্প-বাণিজ্যিক বা সেরা উদ্যোগের জন্য প্রধানত দুই ধরনের মূলধন প্রয়োজন হয়, স্থায়ী মূলধন এবং চলতি মূলধন। স্থায়ী মূলধন প্রয়োজন হয় দীর্ঘ মেয়াদের জন্য, পক্ষান্তরে চলতি মূলধন প্রয়োজন হয় স্বল্প সময়ের জন্য। বর্তমান সভ্যতায় স্টক মার্কেট স্থায়ী মূলধন জোগানের মুখ্য উৎস বলে বিবেচিত হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রধানত চলতি মূলধন সরবরাহ করে থাকে। বাংলাদেশে উদ্যোক্তারা বাণিজ্যিক ব্যাংক হতে স্থায়ী ও চলতি উভয় মূলধন সংগ্রহের চেষ্টা করেন। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংক অর্থ জমাদানকারীদের কাছ থেকে স্বল্প সময়ের জন্য জমা গ্রহণ করে বলে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী মূলধন ঋণ প্রদানে আগ্রহী হয় না। স্বল্প সময়ের জন্য অর্থ জমা গ্রহণ করে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণদান তাদের ব্যবসার গতি বাধাগ্রস্ত করে। বাংলাদেশের স্টক মার্কেট দুর্বল অবস্থানের কারণে প্রয়োজন মতো দীর্ঘমেয়াদি মূলধন জোগানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারছে না।

বাংলাদেশে বিশেষ করে দেশি উদ্যোক্তারা কর্তৃক গঠিত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, যা স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বিতরণে আগ্রহী নয়। ব্যবসা করে উল্লেখযোগ্য মুনাফা অর্জন করলেও তারা শেয়ারহোল্ডারদের তা বিতরণে কার্পণ্য করে থাকে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রদান করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। জুন ২০১৬ অর্থবছর শেষে রংপুর ফাউন্ড্রি শেয়ারপ্রতি নিট মুনাফা করেছে টাকা ৫ দশমিক ৫১ কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ বিতরণ করেছে টাকা ৩ দশমিক ৫০। জুন ২০১৭ অর্থ বছর শেষে বিএসআরএম স্টিল শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ৪ দশমিক ৯৮ অথচ লভ্যাংশ দিয়েছে টাকা ৩ দশমিক ৫০। জুন ২০১৬ অর্থ বছর শেষে বেঙ্গল উইন্ডস শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ২ দশমিক ৫৭ এবং লভ্যাংশ দিয়েছে ১ টাকা । জুন ২০১৬ অর্থবছর শেষে পদ্মা ওয়েল শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ১৯ দশমিক ০৭, লভ্যাংশ দিয়েছে ১০ টাকা। সামিট পাওয়ার জুন ২০১৭ অর্থবছর শেষে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ৫ দশমিক ৭৫ পক্ষান্তরে লভ্যাংশ দিয়েছে ৩ টাকা । ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি জুন ২০১৬ বছর শেষে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ৪ দশমিক ৩২ এবং লভ্যাংশ দিয়েছে এক টাকা। তিতাস গ্যাস জুন ২০১৭ অর্থবছর শেষে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ৫ দশমিক ১২ কিন্তু লভ্যাংশ দিয়েছে ২ দশমিক ২০ টাকা। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ২০১৬ বছর শেষে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ২ দশমিক ৪৯ এবং লভ্যাংশ দিয়েছে টাকা ১ দশমিক ৫০। আমরা টেকনোলজিস জুন ২০০৭ অর্থবছর শেষে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ৩ দশমিক ২২ কিন্তু লভ্যাংশ দিয়েছে ১ টাকা। এতে দেখা যাচেছ যে, সাধারণ বিনিয়োগকারীগণ স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে আকর্ষণীয় মুনাফা পাচ্ছেন না। একই কোম্পানির কয়েক বছরের লভ্যাংশ প্রদানের পরিসংখ্যান অবলোকন করলে দেখা যায় যে, বছর থেকে বছরের লভ্যাংশ বিতরণের ঝোক আকর্ষণীয় নয়। কোম্পানির পরিচালকগণ সব শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণে যৌক্তিক আচরণ করেন না। তবে দেশে ব্যবসা করছে এমন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় আচরণ করে থাকে। রেকিট বেনকিজার বিডি জুন ২০১৭ অর্থবছর শেষে শেয়ারপ্রতি নিট মুনাফা করেছে টাকা ৫৮ দশমিক ৭৩ এবং শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ বিতরণ করেছে ৬৫ টাকা। বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ১০৩ দশমিক ১৮ এবং শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ দিয়েছে ৬০ টাকা । ম্যারিকো বাংলাদেশ মার্চ ২০১৭ অর্থবছর শেষে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ৪২ দশমিক ৭২ এবং শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ বিতরণ করেছে ৫০ টাকা। হেইডেলবার্গ সিমেন্ট ২০১৬ অর্থবছর শেষে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ২৬ দশমিক ৬৯ এবং শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ বিতরণ করেছে ৩০ টাকা। সিঙ্গার বাংলাদেশ ২০১৬ অর্থবছর শেষে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে টাকা ৭ দশমিক ১২ এবং শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ বিতরণ করেছে ৭ টাকা।

বাংলাদেশ অরিজিন কোম্পানিগুলোর পরিচালক পর্ষদ সাধারণভাবে ছোট বড় সব শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি লভ্যাংশ বিতরণের ক্ষেত্রে আনুপাতিক আচরণ করেন না। তারা নিজেরা অন-আনুষ্ঠানিক বিভিন্ন পদ্ধতিতে কোম্পানি হতে আর্থিক ও অন্যান্য বৈশ্বয়িক সুবিধা নিয়ে থাকেন। এতে করে কোম্পানির নিট মুনাফা হ্রাস পায়। তারা সব শেয়ারহোল্ডার পাবে এমন ডিভিডেন্ড প্রদানের সুপারিশ প্রণয়নের সময় সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মুনাফা বিতরণ করতে মোটেই আগ্রহী নয়। এতে করে সাধারণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মালিকেরা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগে উৎসাহ বোধ করেন না। সরকারকে এমন করপোরেট ট্যাক্স ও আয়কর আরোপ করতে হবে যেন স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালক পর্ষদ অধিক হারে লভ্যাংশ বিতরণে উৎসাহিত হয়। যেমন, কোনো একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি যে পরিমাণ অর্থ শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করবে সে পরিমাণ অর্থের বিপরীতে হ্রাসকৃত হারে করপোরেট ট্যাক্স ধার্য করতে হবে। অবশিষ্ট মুনাফার ওপর বর্ধিত হারে করপোরেট ট্যাক্স ধার্য করতে হবে। আবার বিতরণকৃত লভ্যাংশ হতে ব্যক্তি ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপিত হবে। উৎসে কর আরোপের পর শেয়ারহোল্ডার যে নিট লভ্যাংশ পাবে সেটা উক্ত শেয়ারহোল্ডারের আয়কর প্রদত্ত আয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। উক্ত লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারের অন্যান্য কর প্রযোজ্য আয়ের সঙ্গে যুক্ত করে কর ধার্য করা যাবে না। এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালক পর্ষদ সম্ভাব্য উচ্চ হারে লভ্যাংশ সুপারিশ করবে। উচ্চ হারে লভ্যাংশ পেলে এবং উৎসে কর প্রদানকৃত অর্থ শেয়ারহোল্ডারের কর প্রদত্ত আয় হিসেবে বিবেচিত হলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মালিকেরা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে। শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাগণ দীর্ঘ মেয়াদী মূলধন স্টক মার্কেট হতে সংগ্রহ করতে পারবেন। দীর্ঘ মেয়াদী মূলধনের জন্য তাদের বাণিজ্যিক ব্যাংককে বিব্রত করতে হবে না। দেশের অর্থনীতি গতিশীল হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist