জাহাঙ্গীর আলম জাবির

  ০১ জুন, ২০১৮

বদরযুদ্ধ

সত্যের বীজ বপনের দিন

বদরযুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল মুসলিম মিল্লাতের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। বদর মক্কা থেকে ১২০ মাইল ও মদিনা থেকে ৮০ মাইলের মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান, ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে বদর প্রান্তরে অমুসলিম ও মুসলমানদের সঙ্গে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হয়। বদরের যুদ্ধ ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় যুদ্ধের অন্যতম।

মক্কার অমুসলিমদের অত্যাচার এবং মহান আল্লাহপাকের আদেশে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর একটি বছর অতিবাহিত হতে না হতেই মদিনা আক্রমনের সংবাদ শ্রবণে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিচলিত হয়ে উঠলেন। এ সময় ওহি নাজিল হলো, ‘আল্লাহর পথে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। তবে সীমালঙ্ঘন করো না, কারণ আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না (সুরা-বাকারা : ১৯০)।’ দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান। মানবতার মুক্তির দূত হজরত নূর নবী (সা.)-এর আগমনে বদরপ্রান্তর মুখরিত। শুরু হলো যুদ্ধের দামামা। মক্কার অমুসলিমরা এক হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে সমবেত হলো বদর প্রান্তরে। আর প্রিয় নবী (সা.) মাত্র ৩১৩ জন আল্লাহর সৈনিককে নিয়ে উপস্থিত হলেন বদর প্রান্তরে। মহানবী (সা.) অসম এ যুদ্ধে প্রাথমিক কাজ শুরু করলেন আল্লাহর দরবারে সাহায্যের প্রার্থনা কামনা করে। ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনামতে নবী করিম (সা.) বদর যুদ্ধের দিন দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাকে সাহায্য-সহায়তা সম্পর্কে অতীতে যে সব আশা-ভরসা দিয়েছেন, অদ্য তা বাস্তবে পরিণত করুন। হে আল্লাহ! আপনি ইচ্ছা করলে আমি এবং আমার মুসলিম সঙ্গী দলকে নিঃশেষ করে দিতে পারেন। কিন্তু তাহলে আপনার বন্দেগিকারীর অস্তিত্ব ভূপৃষ্ঠ হতে বিলীন হয়ে যাবে।’ এমতাবস্থায় আবু বকর (রা.) এসে হজরতের হাত ধরে বললেন, আপনি ক্ষান্ত হউন, যথেষ্ট দোয়া করেছেন। তখন নবী করিম (সা.) এই আয়াত উচ্চারণ করতে করতে বাইরে আসলেন- ‘সাইহ্যামুল জাময়ু অ-ইয়ু ওয়াল্লুনাদ দুবুর (সুরা কামার : ৪৫)।’ অর্থাৎ অচিরেই শত্রু দল পরাজিত হবে এবং পশ্চাৎপদ হয়ে পালাবে (বোখারি শরিফ)। রাসুলে পাক (সা.) আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করে নেমে পড়েন যুদ্ধের ময়দানে। ১৭ রমজান, শুক্রবার। উঁচু একটি টিলায় একটি শিবির স্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে রণাঙ্গনের দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) আবু বকর (রা.)-কে নিয়ে সেই শিবিরে অবস্থানরত। মদিনার প্রধানতম সরদার সাদ ইবনে মোয়াজ (রা.) উন্মুক্ত তরবারি হাতে সেই শিবিরে পাহারা দিচ্ছিলেন। এদিকে রণাঙ্গনের দুই প্রান্তে উভয় পক্ষের সেনাবাহিনী সারিবদ্ধভাবে রণাঙ্গনে অবতরণের জন্য প্রস্তুত। সর্বপ্রথম শত্রুদলের মধ্য থেকে রবিয়ার দুই পুত্র (১) শায়বা (২) ওতবা এবং ওতবার পুত্র (৩) অলীদ এই তিন ব্যক্তি উন্মুক্ত তরবারি হাতে হুংকার মেরে ময়দানে চলে আসেন এবং মুসলমানদের প্রতি যুদ্ধে অবতরণের হাঁক দেন। তৎক্ষণাৎ মুসলমানদের পক্ষ হতে আনসার মদিনাবাসী তিনজন যুবক সাহাবী তাদের প্রতি উত্তরে আফরা (রা.) নাম্মী সাহাবিয়ার দুই পুত্র (১) আওফ (রা.), (২) মোয়াজ (রা.) এবং (৩) আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) নামলেন। অমুসলিমরা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কারা? তারা গর্বভরে স্বীয় পরিচয় দিলেন, আমরা মদিনার আনসার দল। আমরা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য আসিনি। এই বলে তাদের একজন চিৎকার করল, হে মুহাম্মদ! আমাদের সমকক্ষ ও বংশধরগণকে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত করুন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় চাচা হামজাহ (রা.) ও চাচাত ভাই আলি (রা.) এবং ওবায়দা (রা.)-কে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিলেন। হজরত রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর নির্দেশে রণক্ষেত্রে অগ্রসর হলেন ওবায়দা (রা.), হামজাহ (রা.) এবং আলী (রা.)। আল্লাহ তায়ালার দ্বীন ইসলামের জন্য জেহাদের সর্বপ্রথম দৃশ্য এবং এই তিনজনের মধ্যে আলিই সর্বপ্রথম আক্রমন পরিচালনা করেন (বোখারি শরিফ)। কোরআনে উল্লেখ আছে, এই যুদ্ধে হাজারো ফেরেশতা মুসলমানদের সহায়তার জন্য এসেছিলেন। যুদ্ধ শেষে নিহত মুসলমানদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে দাফন করা হয়। নিহত কুরাইশদের লাশ একটি কূপে নিক্ষেপ করা হয়। আরবের রীতি অনুযায়ী মুসলিমরা তিনদিন যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবস্থান করার পর মদিনায় ফিরে আসেন। যুদ্ধে কয়েকজন কুরাইশ নেতা সহ ৭০ জন বন্দি হন। বন্দিদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা হয়। মুসলমানরা নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দিদের রুটি খেতে দেয়।

বদর যুদ্ধের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য অপরিসীম। ইসলামের ইতিহাস তখন থেকেই মোড় ফেরে। বদর যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ইসলামকে বিবেচনা করা হত দুর্বল। বদর যুদ্ধেই প্রথম প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম দুর্বার, দুর্জয়। দীর্ঘদিন যাবৎ বিধর্মীরা ইসলামকে শৃঙ্খলিত রাখার কত শত চেষ্টাই না করেছে বদর যুদ্ধ শুধুমাত্র একটি সাধারণ ঘটনাই নয় বরং সত্যের জয়, অসত্যের ক্ষয় প্রকৃত পরিচয়। বদর যুদ্ধের বিজয় ইসলাম বেঁচে থাকার উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়। পক্ষান্তরে মিথ্যা কুফুরি চিরতরে উৎখাত হয়। তাইতো বদরের দিনকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের দিন বলা হয়। বদর সত্যের জয় আর অসত্যের ক্ষয়ের দিন। সত্যের বিকাশ অসত্যের বিলুপ্তির দিন। এই যুদ্ধ ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। বদর ইসলামকে একটি বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। বদরের যুদ্ধ জয়ের ফলে মুসলমানদের পার্থিব শক্তির ভিত্তি স্থাপিত হয়। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের মাধ্যমে সত্য ধর্ম ইসলাম বিজয় লাভ করে এবং মিথ্যার ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুসলামন নামক জাতির ভিত্তি রাজনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বদর যুদ্ধ জয়ের পর মুসলমানগণ এ বিশ্বাসে আপ্লুত হয় যে, সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে আল্লাহ্ সর্বদাই তার বান্দাদের শক্তিকে বৃদ্ধি করেন। বদর যুদ্ধের বিজয়কে মুসলমানরা আল্লাহর অসীম আশির্বাদ হিসেবে গণ্য করেন। আল্লাহ মুসলামনদের বিজয় দিয়ে ইসলামকে সুদৃঢ় করেন। বদর যুদ্ধের প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। যুদ্ধ জয়ের ফলে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কর্তৃত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। মদিনা শরিফের অনেকে এ সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের খুবই সম্মানের চোখে দেখা হয়। আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলগণ যেখানে ইসলাম ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিত, সেখানে ইসলামের শত্রুরা তাদের সাধনাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পবিত্র কোরআনে এমন কোনো নবী রাসুলের নাম উল্লেখ নেই, যারা সেই শত্রুদের দ্বারা নিপীড়িত ও নির্যাতিত হননি। যাদের মধ্যে অমানবীয় ও পাশবীয় উপাদান যত বেশি তাদের মধ্যে ইসলাম ও মানবতার বিদ্ধেষও তত বেশি। মানবতার এই শত্রুরাই ইসলামের একাধিক গুণিজনকে হত্যা করেছে। এই শত্রুরাই হযরত মুসা (আ.)-কে স্বদেশ হতে বিতাড়িত করেছে। এই শত্রুরাই হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে পুড়িয়ে মারার চক্রান্ত করেছে, এই শত্রুরাই হজরত ঈসা (আ.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত প্রত্যেক নবী ও রাসুলকেই মানবতার এই শত্রুরা অনবরত নিপীড়ন ও নির্যাতন করেছে। আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.), যিনি মানবজাতি ও মানবসভ্যতার ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী ও রাসুল। যার সাধনা ধৈর্য জ্ঞান, প্রজ্ঞা এক কথায় সমস্ত গুণাবলি মানবজাতি ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে সব যুগের, সব কালের মানুষের জন্য চিরন্তন দৃষ্টান্ত হয়ে আছে তার পূর্বে যত নবী রাসুলের কথা জানতে পারা যায়, তাদের নিরিখে বিচার করলে দেখা যায় যে, মহানবী (সা.)-এর ওপরে মানবতার শত্রুরা অত্যাচার করেছে সবচেয়ে বেশি। তার জীবন ও সাধনায় সাফল্য যেখানে ছিল মানবতার চিরন্তন ও চিরকালীন আদর্শ সেখানে মানবতার শত্রুরা সে সাধনাকে বার বার ব্যর্থ করে দেওয়ার ঘৃণ্য অপপ্রয়াস চালিয়েছে। মানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.)-কে শেষ পর্যন্ত তারা অস্ত্র ধরতে ও যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে ইসলাম মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১৭ রমজান মক্কার অদূরে বদরের প্রান্তরে। এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বলেই এটি মানবজাতি ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ নামে চিরপরিচিত হয়ে আছে।

মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে ইসলামের এক দল নিবেদিতপ্রাণ এবং মানবজাতির অন্যতম কতিপয় মহান সন্তান ইসলাম ও মানবতার এই শত্রুদের বিরুদ্ধে বিশ্ব মানবকল্যাণের জন্য আত্মত্যাগের যে অক্ষয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, মানবজাতি ও মানবসভ্যতার ইতিহাস তা কখনো ভুলবে না। চিরপবিত্র ও মহিমান্বিত রমজান যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইতিহাসে চির অক্ষয় হয়ে আছে আরব মরুভূমির এক অখ্যাত প্রান্তর। বদর যার প্রান্তরে মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্বে সত্যের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে অসম সাহসী একদল বীর মুজাহিদ, মানবজাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান শত্রু সৈন্যদের চেয়ে সংখ্যায় অতি নগণ্য হয়ে মিথ্যা, অসত্য, ইসলাম ও মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ রোজা রাখা অবস্থায়, ক্ষুধার্ত পিপাসায় কাতর, সত্য, সুন্দর শাহাদাতের অমিয়সুধা পান করে ইহ-পরকালে মুক্তি ও অমরত্বের আশায় আত্মদান করে জগতে যে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করে গেছেন, তার মহিমাকে কেউ কখনো ক্ষুণœ করতে পারবে না। সেদিন শত্রুদের চেয়ে সংখ্যায় অতি নগণ্য হয়ে ও মুসলমানরা বিজয় লাভ করেছিলেন, তা ছিল এক চিরন্তন বিজয়। ইসলাম ও মানবতার শত্রুদের পরাজিত করে বদরের প্রান্তরে সেদিন, যে সত্যের বীজ বপণ করেছিলেন, পৃথিবীর আর কোনো শত্রুর পক্ষে, সেই সত্যকে উৎপাটন করা সম্ভব নয়। মহিমান্বিত মাস রমজানকে তাই বদরের মাস বলেও অভিহিত করা যায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist