রায়হান আহমেদ তপাদার

  ৩১ মে, ২০১৮

বিশ্লেষণ

অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি

রাজনীতি বলতে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যেটুকু অনুধাবন করি, তা হলো রাজ্যের কল্যাণে রাজা প্রদত্ত নীতিকেই বোঝায়। এখানে রাজার কোনো ব্যক্তিস্বার্থ লুকায়িত অবস্থায় থাকতে পারে না। আর গণতন্ত্র, সে তো আরো বিস্তৃত অর্থ প্রতিপন্ন করে। গণতান্ত্রিক জাতি কেবল তারাই, যারা নিজের ইচ্ছানুসারে স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষমতা বহন করে। যেকোনো ব্যক্তির নৈতিকতাবিরোধী কর্মকা-ের বিপক্ষে কথা বলতে পারে বা প্রতিবাদ জানাতে নির্ভয়ে এগিয়ে আসতে পারে। যদি রাজা বা সরকার প্রদত্ত নিয়মের বেড়াজালে রাজা বা দেশের সাধারণ জনগণ শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তাহলে সে জাতি কখনোই গণতান্ত্রিক জাতি হতে পারে না।

খুব সাধারণ এক প্রশ্ন তুলে ফার্গুশন, জরগেনশন ও চেন তাদের গবেষণা শুরু করেন। তা হলো, ‘নির্বাচনী খরচের সঙ্গে জয়-পরাজয়ের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা? পাওয়া গেল হতবুদ্ধিকর ফল। প্রধান রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী খরচের সঙ্গে তাদের প্রাপ্ত ভোটের সম্পর্ক খুব শক্তিশালী ও সরাসরি। নির্বাচনে অর্থের ভূমিকাকে যারা এত দিন কোনো গুরুত্বই দেননি, তাদের সে সিদ্ধান্তের চেয়েও অনেক বেশি খরচ করে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল। সাধারণত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসে যা পড়ানো হয়, আমেরিকার গণতন্ত্র আজ তার ধারেকাছেও নেই। তারা বলেন, আমেরিকার বড় ব্যবসায় ফার্ম, করপোরেট গ্রুপগুলো মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী নয়। তারা তাদের আদর্শ অনুযায়ী দুটি বড় দলের একটির পেছনে মুক্ত হস্তে অর্থ অনুদান দেয়। এটাকে বলা যায় ‘নির্বাচনী বিনিয়োগ। তারা বলেন, এরই মধ্যে নিহিত আছে আমেরিকার বৈষম্যমূলক অর্থনীতির বিপদ। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, কেবল ফেডারেল নির্বাচনেই নয়, স্টেট ও স্থানীয় নির্বাচনে অর্থেরই জয় জয়কার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি, গণতন্ত্রপরবর্তী ধাপে পা রাখে, তাহলেও অবস্থার কোনো উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞানী যা মনে করেন, অর্থ যে রাজনৈতিক দলগুলোকে কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরেছে এবং নির্বাচনের ওপর শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করেছে। এই সত্যটা স্বীকার করার সময় এসেছে। প্রধান ধারার সমাজবিজ্ঞানীরা যদি এই সত্যকে স্বীকার না করেন, তাহলে তারা কিসের পেছনে ছুটছেন? তারা স্বীকার করুন বা নাই করুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য এটা শুভ হবে না। দুই দশক ধরে সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এসেছেন এতে আমেরিকার গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছে। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। ওবামা বনাম রমনি। করপোরেট রাঘববোয়ালরা চাইছিল যে নির্বাচনী প্রচারণায় তারা স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণ করবে। কেবল বিলিয়নরাই নয়, শিক্ষাবিদ ও তাত্ত্বিক প-িতরাও জোরের সঙ্গে বলেন, নির্বাচনে যত বেশি অর্থ খরচ হবে, গণতন্ত্র তত বেশি শক্তিশালী ও প্রসারিত হবে।

পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ওপর এক গবেষণা তাদের হতবুদ্ধি করে দেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে গণতন্ত্রের যে সবক দেওয়া হয়, এই গবেষণা তাকে ব্যঙ্গ করে সত্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রমাণ করেছে, অর্থের সঙ্গে ভোটের যোগাযোগ সরাসরি। প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যত বেশি খরচ করবে, তারা তত বেশি ভোট পাবে। নির্বাচনে খরচের সঙ্গে ভোট পাওয়ার সম্পর্ক শতকরা হিসাব সরাসরি সমান্তরাল। গত ১৩ আগস্ট, ২০১৬ ইনস্টিটিউট ফর নিউ ইকোনমিক থিংকিংয়ের প্রবীণ গবেষণা বিশ্লেষক লিন প্যারামোর দ্য নেক্সট এভালোশন অব ইকোনমিকস নামের অর্থনীতি পত্রিকায় লিখেছিলেন, কীভাবে অর্থ আমেরিকার নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে, অবশেষে তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল। ওই ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর থমাস ফার্গুশন এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণায় লিপ্ত। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তার গোল্ডেন রোলস : দি ইনভেস্টম্যান্ট থিওরি অব পার্টি কমপিটিশন বইতে তিনি একাডেমিক প-িতদের চ্যালেঞ্জ জানান এবং দেখান যে কীভাবে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে বৃহত্তর ক্রান্তির আশায় রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ জোগান দেয়। ওবামার নির্বাচনে কীভাবে কত টাকা খরচ করা হয়েছিল, তার হিসাব তুলে ধরে বলেছেন, ‘ফেল কড়ি মাখো তেল’ ‘টাকা ঢালো, ভোট নাও’। ২০১২ সালে ১২ জুলাই কেনেথ পি. ভোগেল, ও ডেন লেভিনথান তিরিনি পার্টি তাদের গবেষণায় জানান, ওবামা ও রমনির নির্বাচনী খরচ এক বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। ওবামার ১.১২৩ বিলিয়ন আর রমনির ১.০১৯ বিলিয়ন। তারা দুজনই অস্বীকার করেন।

১৯৪৯ সালে আইনস্টাইনের মনে এ প্রশ্ন জেগেছিল, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা কতটুকু? উত্তরে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোই প্রার্থী নির্বাচন করে। নির্বাচনে পুঁজিপতিরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এবং নানাভাবে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে। ফলে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ক্ষমতাসীন পুঁজিপতিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সুতরাং জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও তারা জনগণের কোনো সাহায্য করতে পারে না।

কয়েক পুরুষ আগে তার পূর্বপুরুষ বছরের পর বছর ভয়ংকর সব পথ পাড়ি দিয়ে রাজধানী শহর থেকে বহুদূরে গহিন জঙ্গলে কোনো একটি স্থানের জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করেছিল। কয়েক প্রজন্মের মধ্যে তা একটি ছোট্ট পারিবারিক জনপদে পরিণত হয়। সেই জনপদটি কেন্দ্রীয় সরকার দখল করে নেয়। বুয়েনডিয়া বিয়ে করেন ম্যাজিস্ট্রেট ডন অ্যাপোলিয়ার মসকটের মেয়েকে। সে দেশে দুটি রাজনৈতিক দলÑ উদারপন্থি ও রক্ষণশীল। নির্বাচন আসন্ন। কর্নেল বুয়েনডিয়াকে ভোট দিতে হবে। সে দুদলের রাজনৈতিক আদর্শ কী, তা জানে না। তাই শ্বশুরের কাছে জেনে নেয়। শ্বশুর বলেন, উদারপন্থিরা খারাপ মানুষ। তারা পুরোহিতদের ফাঁসি দিতে চায়, তারা বিয়ে ও তালাক সমর্থন করে, তারা বৈধ ও অবৈধ সন্তানদের সমমর্যাদা দিতে চায় এবং ফেডারেল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হ্রাস করতে চায়। অন্যদিকে রক্ষণশীল দল ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তারা দেশে আইনশৃঙ্খলা ও পারিবারিক নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে চায়। তারা যিশুকে বিশ্বাস করে, ক্ষমতাসীনদের প্রতি তারা বিশ্বস্ত এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গঠন করে দেশকে টুকরো টুকরো করতে চায় না।

কর্নেল উদারপন্থিদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং মুক্ত ও স্বাধীন নির্বাচনের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি করা হয়। পুলিশ পাহারায় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মানুষ তাদের ইচ্ছামতো ভোট দেন। কোনো গোলমাল হলো না। কর্নেল বুয়েনডিয়া নিজের চোখে ভোট গ্রহণ দেখলেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সবাই ভোট দিল। রক্ষণশীলদের নীল ব্যালট পেপার আর উদারপন্থিদের লাল। ভোটদান শেষে ম্যাজিস্ট্রেট কর্নেলের শ্বশুর দুদলের প্রতিনিধিদের সামনে ব্যালটবাক্সে সিলগালা করে নিজে তার ওপর স্বাক্ষর করলেন। রাতে তিনি সার্জেন্টকে সিলগালা ভাঙতে বললেন। তারপর যা হওয়ার তাই হলো। অধিকাংশ লাল ব্যালট পেপার বের করে সেখানে নীল ব্যালট পেপার ঢোকানো হলো। তাই দেখে জামাই কর্নেল বলল, উদারপন্থিরা বিদ্রোহ করবেন? উত্তরে শ্বশুর বললেন, কিছু লাল ব্যালট পেপার তো রেখে দিয়েছি। বুঝবে কী করে?

আজ লিন প্যারামোরের লেখা ও ফার্গুশনের গবেষণা প্রমাণ করেছে, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র অর্থের কাছে পরাজিত হয়েছে। ১৯৬৭ সালেই মার্কেজ নির্বাচন সম্পর্কে এ ছবিটিই এঁকেছিলেন তার নোবেল পুরস্কৃত উপন্যাসে। তখনই জনগণের ভোটাধিকার কীভাবে ছিনতাই হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, রক্ষণশীল দল জয়ী হয়েছিল। আর জামাই সে অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন ক্ষমতার মসনদ দখল করতে হবে। তা না হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। গণতন্ত্রের ওপর অর্থের প্রভাব সম্পর্কে উইলিয়াম ব্লামের কিলিং হোপ বইটি জীবন্ত উদাহরণ।

সবশেষে বলা যায়, ভোটের মাধ্যমে মতামত প্রকাশের বা সঠিক রায় প্রদানে জনগণ ভুল করলেও সেটা গণতন্ত্র এবং জনগণের শাসন। এখানেই গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অথবা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার মৌলিকত্ব, বিশেষত্ব এবং গুরুত্ব। একটি মোটরগাড়ি উন্নতমানের নাও হতে পারে। তাই বলে আমরা গরুর গাড়িকে সমর্থন করতে পারি না। কারণ, একটি অনুন্নত মানের মোটরগাড়ি একটি উন্নত মানের গরুর গাড়ির চেয়ে উৎকৃষ্ট। তাই এই গণতান্ত্রিক যুগে, গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার অগ্রগতির যুগে, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিযোগিতার যুগে আমরা অতীতের রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং সামরিক শাসনের খড়্গতলে বলি হতে পারি না।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist