নিতাই চন্দ্র রায়

  ৩০ মে, ২০১৮

মতামত

কৃষিনির্ভর বাজেটই এখন জরুরি

বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য কোনো না কোনোভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। শ্রমশক্তি জরিপ ২০০৮-এর হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত। এ ছাড়া খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন, শিল্পের কাঁচামাল জোগান এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে কৃষির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিজমি হ্রাস, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে কৃষি আজ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। উৎপাদন উপকরণ ও কৃষিশ্রমিকের অস্বাভাবিক মজুরি বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে কৃষি একেবারে অলাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিপণ্য বিক্রি করে উৎপাদন খরচও ওঠানো যাচ্ছে না। তাই উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বাড়ানোর বিকল্প নেই। কৃষির ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি খাতে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কৃষি একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। এ ছাড়া সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও কৃষিকে অবহেলা করা হয়। তরুণদের একটা বড় অংশ শিল্প ও সেবা খাতের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায়। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিক্ষিত যুবকদের কৃষিকাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করা হবে। এবারের বাজেটের আকার হবে ৪ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এটা এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজেট। গত বাজেটের আকার ছিল ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। এবারের বাজেট গত বাজেটের চেয়ে ৫৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা বেশি। কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, কৃষির প্রবৃদ্ধি অন্যান্য খাতের তুলনায় দ্বিগুণ হারে দারিদ্র্য হ্রাস করে। কৃষি একটি উৎপাদনশীল খাত। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন ২০০৮ অনুসারে কৃষি উৎপাদন ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে দারিদ্র্যের হার শতকরা ০.৫ ভাগ হ্রাস পায়। আর বাংলাদেশে পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা যায়, কৃষি উৎপাদন ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে দারিদ্র্যের হার ০.৪১ শতাংশ হ্রাস পায়। অন্যদিকে কৃষিবহির্ভূত খাতে উৎপাদন ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে দারিদ্র্য হ্রাস পায় মাত্র ০.২ শতাংশ। স্বাধীনতার পর দেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩ শতাংশ হারে এবং দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে ১.৪ শতাংশ হারে। এতে প্রতীয়মান হয়, এ দেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্যবিমোচনের একটি নিবিড় ও সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন; অসময়ে অতিবৃষ্টি, বন্যা, জলাবদ্ধতা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, লবণাক্তা, নদীভাঙন, কৃষিশ্রমিকের অভাব, পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধিসহ বাংলাদেশের কৃষি এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। এ ছাড়া দেশে এখনো কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রয়োজনীয় শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠেনি। পণ্য পরিবহনে রয়েছে নানা জটিলতা। অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেটের কারণেও কৃষক পাচ্ছে না তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য। কখনো কখনো তাকে উৎপাদন খরচের চেয়ে কমমূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রি করে চোখের জলে বুক ভিজিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। আবার উৎপাদিত পণ্যটি যতক্ষণ কৃষকের গোলায় থাকে, ততক্ষণ দাম থাকে কম। মহাজনের গুদামে গেলেই, হুহু করে বেড়ে যায় কৃষিপণ্যের দাম। আজ থেকে দুই মাস আগেও উত্তরাঞ্চলের হাটবাজার গ্রানুলা, কার্ডিনাল প্রভৃতি জাতের আলু বিক্রি হয়েছে পাঁচ থেকে সাত টাকা কেজি দরে। কৃষকের ঘরের আলু শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। বাজারে আলুর দাম বেড়ে গেছে। এখন আলু বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে। আলুর বর্ধিত মূল্য দুর্ভাগা কৃষকের কপালে জোটেনি। জুটেছে হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীদের ভাগ্যে। দুবছর ধরে অসময়ে অতিবৃষ্টি, ব্লাস্টরোগ ও বন্যার কারণে বোরো ধান, গম, গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি বিনষ্ট হয়ে ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকরা চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। বোরো ধানের সরকারি সংগ্রহমূল্য প্রতি মণ (৪০ কেজি) ১ হাজার ৪০ হলেও বর্তমানে দেশের হাটবাজারে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৭২০ থেকে ৮০০ টাকা দামে। গত বছরের চেয়ে এ বছার মাছের দাম কম থাকায় মৎস্যচাষিরাও লাভের মুখ দেখছেন না। ডিম, মাংসের কম দাম, খাবার ও ওষুধের দাম বেশি এবং বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক পোলট্রি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেশি। তাই পোলট্রিশিল্পে ব্যবহৃত খাদ্য, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির দাম কমাতে হবে এবং গুণগতমান নিশ্চিতে তদারকি জোরদার করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ফসলের নতুন নতুন জাত এবং উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবনের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য গবেষণা কার্ষক্রম জোরদার করতে হবে এবং কৃষি গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কৃষিজমির উর্বরতা সংরক্ষণে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। কৃষকপর্যায়ে বীজ ব্যাংক স্থাপন করে গুণগত মানের বীজের ব্যবহার নিশ্চিত হবে। এসব কথা দেশের নীতিনির্ধারক, কৃষিবিজ্ঞানীসহ বিশিষ্টজনরা বারবার বলা সত্ত্বেও জাতীয় বাজেটে তার কোনো প্রতি ফলন দৃশ্যমান হচ্ছে না। সম্প্রতি প্রেস ক্লাবের সামনে ১০ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মানববন্ধন করেছে সমাজতান্ত্রিক ক্ষেতমজুর ও কৃষক ফ্রন্ট। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে উৎপাদন খরচের সঙ্গে শতকরা ৩০ ভাগ মূল্য যুক্ত করে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ, প্রতি ইউনিয়নে সরকারি উদ্যোগে কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার ব্যবস্থা, ক্ষেতমজুরের সারা বছরের কাজ, বিএডিসিকে সক্রিয়করণ এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বন্ধ ও কৃষিজমি সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা। কৃষিবিশেষজ্ঞদের মতে, বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে কৃষি খাতে মোটেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। যে হারে মোট বাজেট বাড়ছে, সে হারে কৃষি বাজেট বাড়ানো হচ্ছে না। বাড়ানো হচ্ছে না ভর্তুকির পরিমাণও। ২০০৯-১০ সাল থেকে ২০১৭-১৮ সালে মোট বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬২ দশমিক ১৬ শতাংশ আর সার্বিক কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়েছে ১৩৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ২০১০-১১ সালে মোট বাজেটে কৃষি খাতের হিস্যা ছিল ১০.৪৭ শতাংশ এবং ২০১৭-১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮.৩৩ শতাংশে। ২০০৯-১০ সালে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধিও হার ছিল ৬.৫৬ শতাংশ, ২০১৭-১৮ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৩.০৬ শতাংশ। এতে বোঝা যায়, বাজেটে কৃষির হিস্যা হ্রাসের সঙ্গে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হ্রাসের যুগসূত্র রয়েছে।

কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান, ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, খামার যান্ত্রীকরণে ভর্তুকি প্রদান, চার দফা নন ইউরিয়া সারের দাম হ্রাস, মাটি ও জলবায়ুর ভিত্তিতে ফসলের ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ ই-কৃষির প্রবর্তনসহ বর্তমান সরকারের নানা পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে কৃষিতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। ধান উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়েছে। মাছ, মাংশ, ডিমও দুধ উৎপাদনের অগ্রগতিও ঈর্ষণীয়। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়িয়েছে। ২০১২-১৩ সালে কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। গত বাজেটে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার কোটি টাকায়। ২০১২-১৩ সালে কৃষি ভর্তুকির হিস্যা ছিল মোট বাজেটের ৬.৩৪ শতাংশ এবং ২০১৭-১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩.৫ শতাংশ। ২০৩০ সালে টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দেশের সব মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য কৃষি খাতে মূল বরাদ্দ ও ভর্তুকি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে এবং প্রাকৃতি দুর্যোগ থেকে কৃষকদের বাঁচানোর জন্য শস্যবিমার প্রচলন করতে হবে।

বর্তমানে দেশের প্রায় পাঁচ কোটি লোক নগরে বসবাস করে। ২০২০ সালে নগরবাসীর সংখ্যা হবে ৮.৫ কোটি। প্রতি বছর কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে শতকরা একভাগ হারে। জনসংখ্যা বাড়ছে ১.৩৭ শতাংশ হারে। অন্যদিকে নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে শতকরা ৪ থেকে ৫ ভাগ হারে। এমতাবস্থায় মোট জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশকে কৃষি কর্মকা-ের বাইরে রেখে ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হবে না। তাই পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের প্রতিটি নগর ও তার আশপাশে গ্রামীণ কৃষির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব, পরিকল্পিত নগরীয় কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ এবং দিকনির্দেশনাও থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে নগরীয় সরকার ও নগরীয় কৃষির বাংলাদেশ। তাই যে যাই বলুক, এ বাস্তবতার প্রতিফলন আমাদের জাতীয় বাজেট ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় থাকাটাই হবে অধিক যুক্তিযুক্ত এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতির কাজ।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist