পঞ্চানন মল্লিক
মতামত
পরিচ্ছন্নতা জরুরি
খ্যাতিমান টিভি ও চলচ্চিত্র অভিনেতা মোশাররফ করিমের সাম্প্রতিককালের একটি নাটকের জনপ্রিয় ডায়ালগ ‘এ মুহূর্তে খাঁটি চা কোথায় পাই?’ দর্শকদের বেশ মন জয় করেছে, যা এখন অনেকের মুখে মুখেও শোনা যাচ্ছে। ডায়ালগটিতে মোশাররফ করিম ‘খাঁটি চা’ বলতে সম্ভবত মুখরোচক, তৃপ্তিদায়ক ও গুণগত মানে উন্নত চা-কেই বোঝাতে চেয়েছেন। তবে গুণগত ও মুখে স্বাদ লাগে এমন চায়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মত চা পানও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ অস্বাস্থ্যকর চা বা অপরিচ্ছন্ন পাত্রে চা পান শরীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই চা পানের আগে, যে চা পান করতে যাচ্ছি বা যে পাত্রে বা কাপে চা পান করব, সেটি কতটা পরিচ্ছন্ন বা স্বাস্থ্যসম্মত তা অবশ্যই দেখে নেওয়ার দরকার। বিষয়টিকে আমরা অনেকেই গুরুত্ব দিই না বা উপলব্ধি করি না। অথবা জানা থাকলেও সচেতনতার অভাবে গতানুগতিকভাবে তা চালিয়ে যেতে দেখা যায়। ফলে ছোঁয়াচে ও পানিবাহিত অনেক রোগে এখান থেকে আমাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় বা আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। এটি বিভিন্নভাবে ঘটে থাকে। অনেকে রোগ-জীবাণুযুক্ত হাতে এসে চা দোকানের বিস্কুট, কলা, পাউরুটি, কেক ইত্যাদিতে হাত দেয়। আবার রাস্তার পাশের খোলা জায়গায় অবস্থিত হওয়ায় বাইরে থেকে ধুলাবালু উড়ে এসে এগুলোয় পড়ে। এসব বিস্কুট, রুটি, কেক, চা খেয়ে অন্যরা আক্রান্ত হয়। সর্দি-কাশি, টাইফয়েড, আমাশয়, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি অনেক ছোঁয়াচে রোগ চা দোকান বা ফুটপাতের এ জাতীয় অস্বাস্থ্যকর খাবারের দোকান থেকে ছড়াতে পারে। এসব রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি চা পান করে সেই কাপ ভালো করে পরিষ্কার না করে সুস্থ ব্যক্তি তাতে চা পান করলে সেও এতে আক্রান্ত হতে পারে। এমন অনেক পানিবাহিত রোগের জীবাণু বা ডিম আছে, যা কম বা অল্প তাপমাত্রায় সহজে মরে না। তাই অপরিচ্ছন্ন কাপে চা পান এসব রোগ বিস্তারে সহায়তা করে। আমাদের দেশে চায়ের দোকানগুলো অনেক ক্ষেত্রে খোলামেলা ও অপরিচ্ছন্ন দেখা যায়। প্রতিদিন শত শত মানুষ এসব দোকান থেকে চা পান করে। আবার পরিপাটি দোকানও আছে। মানুষের কাছে সেগুলোর জনপ্রিয়তাও অনেক বেশি। তবে খোলামেলা পথ দোকানের সংখ্যাই এ দেশে বেশি।
চা বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় পানীয়। বাংলাদেশেও এর জনপ্রিয়তার ঘাটতি নেই। তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর চা পানকারীর সংখ্যা গড়ে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য চা এ দেশের নিজস্ব পানীয় নয়। চায়ের সূচনা হয় চীন দেশে। সেখান থেকে ইংল্যান্ডে এটি প্রসারিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সর্বপ্রথম এ দেশে চা নিয়ে আসেন। এখানে চা পানের প্রসারতা বাড়াতে তারা প্রথম প্রথম এ দেশের মানুষকে দুধ, চিনিসহ ফ্রি চা খাওয়াতো। তাদের হাত ধরেই মূলত এ দেশের মানুষের প্রথম চা খেতে শেখা। ক্রমে এখানে চা পানের প্রসারতা বেড়েছে। মানুষের মধ্যে ক্রমে চা পানের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন চা পান করলে এটি অনেকের অভ্যাসে পরিণত হয়। চা এখন আমাদের মেহমানদারির অন্যতম প্রধান উপকরণে পরিণত হয়েছে। বাড়িতে মেহমান এলে অন্তত এক কাপ চা খাওয়ান না এমন ভদ্রলোক খুব কমই পাওয়া যায়। যেকোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান, বিয়ে-শাদি ইত্যাদিতে মেহমানদের প্রথমেই চা দিয়ে আপ্যায়ন করতে হয়। তবে বাড়ি অপেক্ষা বাইরের চা দোকানগুলোতেই মানুষজনকে বেশি চা পান করতে দেখা যায়। সকালের হালকা নাশতায়, বিকেলের চায়ের দোকানে বন্ধুদের আড্ডায় কাপের পর কাপ চা উঠে যায়। রাস্তাঘাট, বাজারে হঠাৎ করে পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে কাছে চা দোকানে বসে চা পান করান অনেকেই। চা পানের ফাঁকে সামান্য আলাপচারিতাও সেরে নেন। এভাবে চায়ের দোকানগুলোয় প্রতিদিন শত শত কাপ চা বিক্রি হতে দেখা যায়।
চা বিক্রির এই জনপ্রিয়তাকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অলিগলিতে, বিভিন্ন হাটবাজার, রাস্তার মোড়, খেয়াঘাট, লঞ্চঘাট, অফিসপাড়া, স্কুল-কলেজ, আদালতসংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় চায়ের দোকান। চায়ের দোকানের ব্যবসায় পুঁজি লাগে কম, তা ছাড়া খুব বেশি জায়গারও দরকার হয় না। তাই নিম্নবিত্তরা জীবিকার তাগিদে সহজেই ঝোঁকেন এ পেশায়। এদের অনেকের মধ্যেই স্বাস্থ্যগত তেমন কোনো অভিজ্ঞান নেই বললেই চলে। রোগ-জীবাণু কি ও কেন ক্ষতিকর বা কীভাবে ছড়ায়, সে সম্পর্কে তারা তেমন কিছু জানে না বা বোঝে না বলা যায়। তারা শুধু নিজেদের ব্যবসা ও মুনাফার কথা চিন্তা করে। অনেক সময় ব্যস্ততার কারণে কাপ ভালোভাবে ধোয়া হয় না। অনেকে অনিরাপদ পানি ব্যবহার করে, আবার অনেকের হাত অপরিষ্কার থাকে। এসব ক্ষেত্রে নেই পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা। রাস্তার পাশে যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব দোকানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নেই তেমন কোনো গুরুত্ব। ফলে চা পানকারীদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার বিষয়টি থেকে যায় উপেক্ষিত। অনেকের ইচ্ছা না থাকলেও বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধ রাখতে গিয়ে প্রায়ই গলাধীকরণ করতে হয় এসব দোকানের চা। ফলে থেকে যায় ছোঁয়াচে ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা।
চায়ের দোকানের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অনেকে পেটের দায়ে বেছে নিয়েছে এমন যত্রতত্র চা বিক্রির ব্যবসা। তারা স্বল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর বলে তাদের ভেতরে স্বাস্থ্যজ্ঞান কম থাকাটা স্বাভাবিক। তাদের বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে নিরাপদ ও উপযুক্ত পরিবেশে তাদের পুনর্বাসিত করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত উপকরণ ব্যবহারে আগ্রহী এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে তাদের চায়ের দোকানের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ অনেকটা দূর করে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। যেভাবেই হোক জনস্বাস্থ্য ও মানুষের রুচির কথা বিবেচনা করে দেশের সব চা দোকানের পরিবেশ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত করার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
"