রেজাউল করিম খান

  ২৮ মে, ২০১৮

বিশ্লেষণ

মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান

বন্দুকযুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী জাবেদ সাহেব বেজাই খুশি। কারণ তার একমাত্র ছেলে মাদকাসক্ত। কোনোভাবেই নিরাময় সম্ভব হচ্ছে না। মাদকের ছোবলে তার সংসার তছনছ হয়ে গেছে। সামাজিক অবস্থান, লোকলজ্জা ও মাতৃস্নেহের কারণে ছেলেকে হাজতেও দেওয়া যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় সরকারের মাদকবিরোধী অভিযানকে তিনি ভেতরে ভেতরে স্বাগত জানিয়েছেন। এবার হয়তো তার সন্তান মাদকমুক্ত হবে। দেশে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা নেহাত কম না। নানা পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ মাদকসেবী। এদের মধ্যে শিশু ও নারীও আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সব মাদক সমান ক্ষতিকর নয়। আবার কিছু মাদক মারাত্মক ক্ষতিকর। মানুষের চেতনা ও অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে, তেমন দ্রব্যকে মাদক বলা হয়। এ জাতীয় ওষুধও পাওয়া যায়। মানুষের স্বাভাবিক মানসিক ক্রিয়ার ওপর প্রভাববিস্তারকারী প্রক্রিয়া গ্রহণকে নেশা বা আসক্তি বলে। মাদক গ্রহণকারী শুধু নিজের জীবনকেই ধ্বংস করে না, এর সামাজিক ক্ষতিও অপূরণীয়। বাংলাদেশে কিছুকাল আগেও সর্বাধিক ব্যবহার হয়েছে ভারতে তৈরি ফেনসিডিল। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উত্তেজক ট্যাবলেট ইয়াবা, যা মূলত মেথামফেটাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণ। ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে, প্রায় প্রকাশ্যেই। মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত আছে ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাসহ নানা পেশার মানুষ।

কেমন আছে বর্তমান প্রজন্ম? এই প্রশ্নের উত্তর অজানা নয় সচেতন কারো কাছে। অনেকেই বলতে পারবেন না, ‘আমার সন্তান ভালো আছে।’ অর্থাৎ অনেকে ভালো নেই। ওরা নেশায় আচ্ছন্ন। অবসন্ন শরীর নিয়ে মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। লেখাপড়ায় অমনোযোগী, স্কুল-কলেজে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, মুঠোফোনে বেশি কথা বলা, ফেসবুক দেখা প্রভৃতি কাজে তরুণরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারের সন্তানরা এসবের জন্য প্রযোজনীয় টাকা সহজেই পাচ্ছে। কিন্তু সমস্যায় পড়ছে নি¤œ আয়ের পরিবারের ছেলেরা। সাধারণ শিক্ষায় অর্ধশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের জন্য এই দেশে সম্মানজনক কোনো কাজ মেলে না। বেকার জীবনের ভয়ংকর দিনগুলোকে দুঃস্বপ্ন আর অভিশাপ মনে হয়। অনেকে যায় রাজনৈতিক দলের নেতার কাছে। সেখানে প্রশ্রয়, সমাদর ও অর্থ মেলে। মেলে মাদকদ্রব্য। মাদকের প্রভাবে তখন কোনো কাজই অসম্ভব মনে হয় না।

কৌতূহল, পারিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, বন্ধুদের কুপ্রচারণা, অসৎসঙ্গ, নানা রকম হতাশা ও আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। প্রায় সব ধরনের মাদকদ্রব্য এখন সহজলভ্য বাংলাদেশে। এর মধ্যে আছে মদ, গাঁজা, চরস, ভাং, চুয়ানি, হেরোইন, ফেনসিডিল, এলএসডি, মরফিন, প্যাথেড্রিন ও ইয়াবা। বর্তমানে হেরোইন ও ফেনসিডিলের চেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে ইয়াবা। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ইয়াবার আনন্দ আর উত্তেজনা আসক্তদের সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা। তারা বাস করে স্বপ্নের জগতে। যৌন উত্তেজক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে এটি। ক্ষুধা কমিয়ে দেয় বলে সিøম হওয়ার ওষুধ হিসেবেও সেবন করা হয় ইয়াবা। কিন্তু এসবই ক্ষণস্থায়ী। আনন্দের পর আসে অবসাদ। ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি। বাড়ে রক্তচাপ। দীর্ঘদিন আসক্তদের মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তনালি ক্ষয় হতে থাকে, শুরু হয় রক্তক্ষরণ। অবশেষে মৃত্যু।’

১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১০-এর ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘পারমিট ছাড়া কোনো ব্যক্তি এলকোহল পান করিতে পারিবেন না। চিকিৎসার প্রয়োজনে অন্যূন সিভিল সার্জন বা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের কোনো সহযোগী অধ্যাপকের লিখিত ব্যবস্থাপত্রের ভিত্তি ছাড়া কোনো মুসলমানকে এলকোহল পান করার জন্য পারমিট দেওয়া যাইবে না।’ এই আইন বহাল আছে। কিন্তু বাস্তবে অবাধে মদ্যপানে কোনো বাধা নেই। এ ক্ষেত্রে আইন অনেকটাই অকার্যকর। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বরাতে গত বছর সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় ৪০টি হোটেল- রেস্তরাঁয় চালু রয়েছে মিনি বার। সেখানে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বিদেশি মদ ও বিয়ার। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া খুবই কঠিন। মাঝেমধ্যে সে চেষ্টা করাও হয়। কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। কিন্তু সারা দেশের চিত্র ভিন্ন। সহজলভ্যের কারণে মাদকাসক্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুবসমাজ যত বেশি মাদকাসক্ত হবে, তত বেশি অলস, অসুস্থ, অকর্মণ্য হবে। এমনই বাস্তবতায় গত ৩ মে র‌্যাবের ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে র‌্যাব কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে র‌্যাব ও পুলিশ কোমর বেঁধে অভিযানে নামে। সঙ্গে যোগ দেয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। মনে হয় এর আগে ওরা সবাই ঘুমিয়ে ছিল। অভিযান শুরু হয় ১৫ মে থেকে।

মাদকবিরোধী অভিযানে গত দুই সপ্তাহে সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৭০ জনেরও বেশি মানুষ। গ্রেফতার হয়েছে তিন সহস্রাধিক। সাজা দেওয়া হয়েছে প্রায় দুই হাজার জনকে। এদের অধিকাংশই মাদক সেবনকারী। পুলিশের কেউ কেউ বলছে, এদের ধরলে বা সাজা দিলে ভয় পেয়ে তারা নেশা ছাড়বে। পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল এফেয়ার্স) মনিরুজ্জামান বলেন, সারা দেশে মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন রোধে মাসব্যাপী এই ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হয়েছে। সরকার সমর্থিতরা র‌্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ার সমর্থন করলেও অন্যরা এর বিরোধিতা করছেন। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেন, বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। কারা ব্যবসা করছে, কারা এদের মদদ দিচ্ছে, এর মূল খুঁজে বের করতে হবে। তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পথ খুঁজতে হবে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, ক্রসফায়ারে মাদক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব। ১৯৯০ সালের মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনের অধিকাংশ পরিবর্তন করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৭ করা হয়েছে। এতে সাতটি ধারা ও ২৮টি সংজ্ঞা সংযোজিত হয়েছে। ইয়াবাসহ নতুন ও পুরোনো আইনে ইয়াবা, সিসাসহ বিভিন্ন মাদকের ব্যবহারে কী শাস্তি হবে, তা উল্লেখ ছিল না। এর অর্থ জোগানদাতা, পৃষ্ঠপোষক, মদদদাতা, সেবনকারী, বহনকারীর অপরাধভেদে শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে মৃত্যুদ- ও এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের ডোপ টেস্ট করা যাবে। সুতরাং একজন মাদক ব্যবসায়ী বা পাচারকারীকে এই আইনের আওতায় সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া সম্ভব।

মাদকসংশ্লিষ্ট সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে তৎপর থাকতে হবে। দেশে মাদকের প্রবেশ ও সরবরাহ লাইন বন্ধ করতে হবে। সোর্সদের টাকার পরিবর্তে আটক হওয়া ইয়াবা দেওয়া যাবে না। মাদকের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সন্দেহজনক আয়ের উৎস দুদক দিয়ে তদন্ত করা। রোহিঙ্গাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে লোকবল নিয়োগ করা। মিয়ানমারে ইয়াবা তৈরির কারখানা বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist