রায়হান আহমেদ তপাদার
পর্যালোচনা
অগণতান্ত্রিক গণতন্ত্রে মিয়ানমার
দীর্ঘ ২৫ বছর পর মিয়ানমারে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, ওই নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) বিপুল বিজয়ের পরও মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। মিয়ানমার একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবেÑএটা বিবেচনায় আনাও ঠিক হবে না। কেননা সেনাবাহিনী এখনো সেখানে একটি রাজনৈতিক শক্তি। একসময় ইন্দোনেশিয়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট সুহার্তোর জমানায় (১৯৬৬-৯৮) সেনাবাহিনী সেখানে এক ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করত, আজকের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেই রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করছে। সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট একাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। প্রশাসনে, অর্থনীতিতে সেনা কর্তৃত্ব বিদ্যমান। একটি করপোরেট শক্তি হিসেবে (অনেকটা মিসরের মতো) সেনাবাহিনী সেখানে ভূমিকা রাখছে। উপরন্তু মিয়ানমারে বিভিন্ন রাজ্যে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডাররা স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী শক্তি হিসেবে পরিণত হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এনএলডির সম্পর্ক ভালো নয়।
অং সান সু চির একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে, মিয়ানমারে অনেক রাজ্যেই তার দলের অবস্থান অনেক দুর্বল। স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক শক্তিশালী। ফলে অং সান সু চির দল নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে সত্য; কিন্তু মিয়ানমারে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সংসদের উভয় কক্ষেই সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। আর এই সেনা প্রতিনিধিত্ব, অর্থাৎ সংসদে সেনা প্রতিনিধিদের মনোনয়ন দেন সেনাপ্রধান। খুব সংগত কারণেই সেনাপ্রধানের চিন্তা-চেতনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু তিনটি মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে সাংবিধানিকভাবেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো ভূমিকা নেই। পুলিশপ্রধান, সেনাপ্রধান, সীমান্ত রক্ষা ব্যবস্থাপনা তথা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর ভূমিকাই মুখ্য। অর্থাৎ নির্বাচনে বিজয়ী হলেও অং সান সু চির এসব ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা থাকবে না। নির্বাচনে তার দলের বিজয় অনেকটাই প্রত্যাশিত ছিল। অনেকটা আরব বসন্তের মতো জোয়ার এসেছে মিয়ানমারে। কিন্তু এর ফলে মিয়ানমার একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে, এ কথাটা নির্বাচনের আগেই প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এক টুইটার বার্তায় জানিয়ে দিয়েছিলেন। এই প্রথমবারের মতো মুসলমানদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকল না সংসদে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়েও কথা থাকল। সুতরাং পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে সেনাবাহিনী সম্ভবত ১৯৯০ সালের মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফল কে বাতিল করে দেবে না। এখন এনএলডি নেতৃত্ব যদি সেনাবাহিনীর ভূমিকা মেনে নেয়, তাহলে মিয়ানমারের গণতন্ত্র একটি নয়া রূপ পাবে। সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এ রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানিরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনসহ বার্মায় আক্রমণ করে। ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। এ সময়ে ব্রিটিশপন্থিদের সঙ্গে বার্মার জাতীয়তাবাদীদেরও সংঘর্ষ হয়। জাপানিদের আক্রমণের সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্থি অস্ত্রধারী মুসলমানদের দল বাফার জোন সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গারা যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেছিল এবং জাপানি শক্তির বিরোধিতা করেছিল, পর্যবেক্ষণে সাহায্য করেছিল মিত্রশক্তিকে। ফলে জাপানিরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল। এ সময় প্রায় ২২,০০০ রোহিঙ্গা সংঘর্ষ এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশান্তরী হয়। জাপানি এবং বার্মার হাতে বারবার গণহত্যার শিকার হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা তখন থেকেই দেশ ছাড়তে থাকে। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসানের পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জীবনে শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। জোর করে কেড়ে নেওয়া হয় সহায়-সম্পদ ও নানা মানবিক-আইনগত অধিকার। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে আরাকানি রোহিঙ্গাদের।
তা ছাড়া বিয়ে করার অনুমতি ছিনিয়ে নিয়ে সন্তান হলে তাদের নাগরিক হিসাবে নিবন্ধন করা বন্ধ থাকে। তাদের জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ। মিয়ানমারের মূল ভূখ-ের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। বিদেশিদেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা ও অবজ্ঞা। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির সময় আরেকটি বিরাট রাজনৈতিক ভুলের অবতারণা ঘটে। তারা জিন্নাহের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। সেই সঙ্গে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের কপাল পোড়া। তাদের এ কাজটা আরাকানের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি। তাদের কপালে ‘বেইমান’ তকমা লেগে যায়। এদিকে জিন্নাহ শেষমেশ অস্বীকৃতি জানায়। তখন তারা নিজেরাই রোহিঙ্গা মুসলিম পার্টি গঠন করে আরাকান স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। আর তারা একদম ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে যায় বার্মার সরকারের কাছে।
১৯৬২ সালে সামরিক সরকার বার্মায় ক্ষমতা পেলে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার বেড়ে যায়। ১৯৭৮ আর ১৯৯২ সালে দুবার তাদের ওপর সামরিক অভিযান চালানো হলে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পালায়। এই আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ২০১৭ সালের আগস্টে শুরু হওয়া আক্রমণেও লাখ লাখ রোহিঙ্গা গৃহহীন-উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকলেও ১৯৬২ সালের পর থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জেনারেল নে উইন বিএসপিপি বা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি গঠন করেছিলেন। ঠিক একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন গঠন করা হয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠন করা হয়েছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুসারে, ১৯৭৮ সাল থেকে মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা নতুন করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে স্বদেশ ছেড়ে বিশ্বের দেশে দেশে পালিয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নাগামান (ড্রাগন রাজা) অভিযানের ফলে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সরকারিভাবে এই অভিযান ছিল প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যেসব বিদেশি অবৈধভাবে মিয়ানমারে বসবাস করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই সেনা অভিযান সরাসরি ও বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলছিল এবং ফলে ব্যাপক গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের ঘটনা ঘটে। পরে ১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন দাঙ্গায় প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। ২০০৫ সালে, জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। বিশেষত ২০১৫ সময়কালে তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছে। এখন যা ১১ লাখকে ছাড়িয়েছে। আর বিশ্ব বিবেক হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে তথাকথিত সভ্যতার সেই নান্দনিক(!) নিদর্শন দেখছে।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
"