সেলিম মন্ডল

  ২৭ মে, ২০১৮

বিশ্লেষণ

স্বেচ্ছাচারিতা বনাম স্বাভাবিক মৃত্যু

সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ক্রমে অগ্রসরমান হওয়া সত্ত্বেও বহু মানুষ এখনো হতদরিদ্র ও অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছে। সামান্য কিছু দান-অনুদানের জন্য সে হোক ইফতারসামগ্রী অথবা জাকাতের টাকা কিংবা শাড়ি-লুঙ্গি, সেখানেই হাজার হাজার মানুষ তীর্থের কাকের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, ভিড় জমায়। ঝড়-বৃষ্টি, দাবদাহ কিংবা প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি যা-ই থাক, সব সত্ত্বেও দান বা সাহায্যের আশায় তারা ধৈর্যসহ দীর্ঘসময় অপেক্ষায় থাকে। প্রতি বছর রমজান মাসে দান-খয়রাত, ইফতার, ফিতরা, জাকাত বিতরণ করার সময় কার আগে কে পাবে এ নিয়ে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। কয়েক বছর ধরে এ রকম অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব ঘটনায় সাহায্যপ্রার্থী বহু নিরীহ লোকের প্রাণ গেছে। তবু আয়োজকদের ঘুম ভাঙে না, রাষ্ট্রযন্ত্রেরও টনক নড়ে না। কাজেই এসব ধর্মীয় অনুশাসন(!) পালন করা প্রত্যেক নাগরিকেরই সাংবিধানিক অধিকার। সহায়-সম্বলহীন, দুস্থ-দরিদ্রদের মধ্যে দান-দক্ষিণা ও সাহায্য প্রদান অবশ্যই ভালো কাজ, মহৎ কাজ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রতিটি কাজের পেছনেই উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব থাকা চাই। ধর্মীয় অনুশাসনের বেলায়ও তা অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত গাফিলতি কিংবা অসতর্কতার কারণে ভালো করতে যদি মন্দ হয়, মানুষের কল্যাণ করতে গিয়ে যদি জীবনহানির কারণ ঘটে, তবে তার পরিণতি অবশ্যই মন্দ। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও তাতে পুণ্যের বদলে পাপের ভাগি হওয়াই অনিবার্য পরিণাম। জাকাত, খয়রাত, দান কিংবা ত্রাণসহায়তার নামে মানুষের এ রকম সস্তা মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় কবির স্টিল রি-রোলিং মিলের (কেএসআরএম) পক্ষ থেকে ইফতার বিতরণের আয়োজন হয়েছিল। ইফতারসামগ্রীর জন্য মধ্যরাত থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু সমবেত হয়েছিলেন সামান্য কিছু চিনি, ছোলা, সেমাই, পেঁয়াজসহ ১৩ ধরনের পণ্যের একটি প্যাকেট ও নগদ এক হাজার করে টাকা পাওয়ার আশায়। একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাদের এভাবে সমবেত হওয়ার জন্য রীতিমতো প্রলুব্ধ করেছিল নানাভাবে প্রচার চালিয়ে। ফলে আগতদের ভিড়ের চাপে তথা পদদলিত হয়ে প্রাণ হারাল ১০ জন দুস্থ-অসহায় মানুষ। আর এ ঘটনায় আহত হয়েছে অর্ধশত। কারো কারো হয়তো এরই ক্ষতচি?হ্ন নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাটাতে হবে বাকি জীবন। বিষয়টির গুরুত্ব¡ বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে সরকারি প্রশাসন। কিন্তু তদন্তের পর আমরা কি কোনো ফল পাব? বাস্তবতা বলছে, না, কোনো সমাধান নেই। প্রতিবারই রোজায় বা ঈদের আগে জাকাতের নামে হতদরিদ্রদের মধ্যে করুণা ছড়াতে গিয়ে বরং উল্টো তাদের জীবন নিয়েই ছিনিমিনি খেলছে ধনাঢ্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠী।

এর আগে একই প্রতিষ্ঠান ২০০৫ সালে জাকাত বিতরণের আয়োজনে আটজনের মৃত্যুর ঘটনা থেকেও স্পষ্টতই শিক্ষা গ্রহণ করা হয়নি। তার পরও এবার সাতকানিয়ায় আয়োজক সংস্থাটি ২০ হাজারের মতো প্যাকেট তৈরি করেছিল। তাদের প্রচারণার ফলে অন্তত ৩৫ হাজার লোকের সমাগম ঘটেছিল। লাইনে দাঁড়ানো মানুষের তুলনায় প্যাকেট কম হলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য এমন ধারণাই যথেষ্ট। ২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর আয়োজিত মেজবানিতে পদদলিত হয়ে মৃত্যু হয় ১০ জনের। জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি কিংবা নগদ অর্থ বিতরণের সময় মৃত্যুর ঘটনা নিয়মিত ঘটছেই।

কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ঘটনাস্থলে ১০০ জন পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু সে দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। আগে থেকেই পুলিশকে এ বিষয়ে লিখিতভাবে সহযোগিতা চেয়ে কোনো পত্র দেয়নি কর্তৃপক্ষ। তবে মৌখিকভাবে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল সাতকানিয়া থানা পুলিশের কাছে। এ কারণে সাতকানিয়া থানা পুলিশ ১৫ জনের একটি পুলিশ দল ঘটনাস্থলে মোতায়েন করেছিল। তাদের বেশির ভাগই নারী পুলিশ সদস্য। ২০১৫ সালেও বাংলাদেশে পদদলিত হয়ে হতাহতের দুটি বড় ঘটনা ঘটে। একটি ময়মনসিংহে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে হুড়াহুড়িতে ২৭ নারী ও শিশুর মৃত্যু। আর অন্যটি তার আগে মার্চে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী পুণ্যস্নানের সময় পদদলিত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়। এমন করুণ মৃত্যু, এভাবে জীবনের আলো নিভে যাওয়া! এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

বাংলাদেশে গরিবের হার কমছে, এটা সত্যি। কিন্তু এখনো বিপুলসংখ্যক হতদরিদ্র মানুষ কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করছেÑএটাও বাস্তব। একটু সাহায্যের আশায় তারা গভীর রাতেও পথ পাড়ি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রান্তিক্লান্তিহীন দেহে অপেক্ষার প্রহর গোনেÑতারই সাক্ষ্য বহন করে সাতকানিয়ার ঘটনা। দান-খয়রাতের মতো মহৎ কাজটি করার ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ কেউ কাজটি করেন নীরবে-নিভৃতে আবার কেউ কেউ করে মাইকিং বা অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে ঢাকঢোল পিটিয়ে। কারো কারো নাম জাহির করার মতলবটিও একেবারে অপ্রকাশ্য থাকে না। বিশেষ করে ধর্মীয় কেনো উৎসব বা দুর্যোগের সময় বিষয়টা ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। ধনীর দুয়ারে ধর্না দেয়া অসহায় মানুষগুলোর দারিদ্র্যের সুযোগে ধনাঢ্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দান-খয়রাত করে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ‘ডান হাতে দান করলে বাম হাত যেন টের না পায়।’ গোপনে দান করায় অধিক ফজিলতের কথাও বহু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাবিধিও মেনে চলা আবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষমতাবান ধনাঢ্যরা কখনো কোনো নিয়মনীতি মেনে চলেছেনÑএমন নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সে কারণেই অসহায় মানুষরা পিষ্ট হয়ে মরছে কখনো পায়ের তলায়, কখনো গাড়ির চাকায়, আবার কখনোবা দুর্নীতির জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে। সাতকানিয়ার মতো এমন দুর্ঘটনার খবর সংবাদ-মাধ্যমে দেখলে এমনটি মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এই দেশে মানুষের জীবনের মূল্য খুব সামান্যই। ১০০টি ঘটনার মধ্যে যদি একটিতেও দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে যদি জনগণের জীবনের নিরাপত্তাই না থাকে, তাহলে এ রকম ঢাকঢোল পিটিয়ে দান-খয়রাতের আনুষ্ঠানিকতার আদৌ প্রয়োজন আছে কি?

আমরা আশা করছি, অতঃপর ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাকাত বা রিলিফ বিতরণের আয়োজন করা হলে সাতকানিয়া এবং অন্যান্য স্থানের অভিজ্ঞতা সক্রিয় বিবেচনায় রাখা হবে। সাতকানিয়ায় নিহতদের প্রতিজনের পরিবারকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তিন লাখ করে টাকা দেবে বলে জানিয়েছে। আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার তারা বহন করবে। নিহতদের পরিবারের কেউ ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরিপ্রার্থী হলে সেটাও বিবেচনা করা হবে। এ ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। মানুষের প্রাণের মূল্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে হয় না। কিন্তু দ্রুতই প্রতিষ্ঠানটি এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছে। এটাও প্রত্যাশিত, অন্যান্য সূত্র থেকেও নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

জনবহুল একটি দেশে যেকোনো জনসমাবেশে জনতাকে সুশৃঙ্খল আচরণের পরিচয় দিতে হবে। তা না হলে এ রকম পদদলিতের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। জাতি হিসেবে আমরা খুব সুশৃঙ্খল নই। কিন্তু যন্ত্রসভ্যতার কল্যাণে আমাদের শৃঙ্খলা না মেনে উপায় নেই। বাস্তবতাই আমাদের বিধিশৃঙ্খলা মেনে চলতে বাধ্য করে। বাসের টিকিট হাতে, ব্যাংকের বুথে কিংবা স্টেডিয়ামের গেটে মানুষ আজকাল সারিবদ্ধভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। মাত্র দু-তিন দশক আগেও এমনটা ছিল না। তুলনায় পরিস্থিতির কিছু না কিছু উন্নতি যে হয়েছে এ কথা অনস্বীকার্য। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠতে পেরে আমরা দেশটি নিয়ে গর্ববোধ করি। সরকারকেও বাহবা দিচ্ছি। কিন্তু যথেষ্ট উন্নয়ন-অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের কোটি মানুষের জীবনযাত্রা বদলায়নি, বরং অভাব-বঞ্চনা ও দারিদ্র্যই যেন তাদের ছায়ার মতো নিত্যদিনের সাথি, অখ-নীয় ললাটলিপি, এটা কি আমরা অনুধাবন করতে পারছি? তাই গরিব মানুষরা নিজেদের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিচ্ছে মাত্র ৬-৭ টাকার জিনিসপত্রের জন্য-এটাই হলো বাস্তবতা। এই গরিবরা উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে পারছে না। চরমভাবে বৈষম্যের শিকার তারা। সম্পদের সুষম বণ্টন না থাকায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বদলাতে সরকারের চলমান সুফলও তারা পাচ্ছে না।

কিন্তু আজও রাস্তায় যানজটের মধ্যে, ধর্মীয় উৎসব, দান-খয়রাত কিংবা কুলখানিতে মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলার তীব্র অভাব পরিলক্ষিত হয়। আগে এসব কাজে নিজ দায়িত্বে অনেকেই স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বপালনে অবতীর্ণ হতো, এখন সে-প্রবণতাও অনেকটাই কমে গেছে। তাই যেকোনো জনসমাগমের ক্ষেত্রে আয়োজকদের শৃঙ্খলার জন্য যেমন দক্ষ লোকবল নিয়োগ করতে হবে, তেমনি জনগণকেও নিজ নিজ নিরাপত্তার তাগিদেই নিজেদের সুশৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। আয়োজক ও প্রশাসনকে এ-বিষয়ে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ব্যাপারটা যেহেতু মানুষের অমূল্য জীবন নিয়ে সে কারণে এ ধরনের যেকোনো উদ্যোগ-আয়োজনের আগেভাগেই শৃঙ্খলা-রক্ষার প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কোনো তরফের অবহেলা বা তাচ্ছিল্যের কিছুমাত্র অবকাশ নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist