মোহাম্মদ আবু নোমান

  ২৬ মে, ২০১৮

নিবন্ধ

আগেই প্রত্যাশিত ছিল এ যুদ্ধ

পিছন ফিরে তাকানো বা দেরি করার মোটেই কোনো সুযোগ ও সময় নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সার্বিক পরিস্থিতি হলো ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ড্যান্ডি, গাঁজা, ভায়াগ্রা ও নেশামিশ্রিত এনার্জি ড্রিংকসে ভাসছে সারা দেশ। ইয়াবার নেশায় বুঁদ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী। মাদক নিয়ে সমাজের সর্বস্তরের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। এর আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে বলা হয়েছিলÑ শিক্ষার্থীরাই বেশি ইয়াবা সেবন করে। ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ এ সেøাগান ধারণ করে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে র‌্যাবকে। শান্তিপ্রিয় পুরো জাতি শতভাগ এ যুদ্ধের পক্ষে। জনগণ মাদকের বিরুদ্ধে নেওয়া যেকোনো পদক্ষেপকে স্বাগত জানাবে। তাদের মেরে না ফেললে, পুরো জাতি মরে যাবে। সঠিক আইডেন্টিফাইয়ের মাধ্যমে এ অভিযান আরো কঠোর ও নিষ্ঠুরভাবে হলেও চালিয়ে যেতে হবে। মাদক বিক্রেতারা যত জীবন নষ্ট করেছে, মৃত্যুর চেয়েও আরো কঠিন শাস্তি থাকলে তা প্রাপ্য ছিল ওদের। আমরা মাদক প্রজন্ম চাই না। আমরা চাই মাদকমুক্ত সুন্দর ও উজ্জ্বল প্রজন্ম। আমরা মাদক নামক ময়লা থেকে পরিষ্কার হতে চাই। সর্বনাশা মাদকের সর্বগ্রাসী ছোবল থেকে রক্ষা পেতে একটি কার্যকর, ক্রিয়াশীল, জোরালো ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ অনেক আগেই প্রত্যাশিত ছিল। সুতরাং, মাদক কারবারিদের কঠোর থেকে কঠোরভাবে দমন করার বিষয়ে সাধারণভাবে দ্বিমতের কোনোই সুযোগ নেই। মাদকসেবী আর বিক্রয়কারীদের মনে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করতে হবে, যাতে ওরা বুঝতে পারে এ কাজ করলে জীবন বাঁচবে না।

র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন, ‘হু এভার, হোয়াট এভার, হয়ার এভারÑকেউ আমাদের অপারেশনের বাইরে নয়। মাদকের শিকড়-বাকড়সহ তুলে নিয়ে আসব।’ সত্যিই যেন তাই হয়। তবে বেঘোরে কিছু মানুষ মরে যাবে, আর আসল অপরাধী আয়েশ করে জীবন উপভোগ করবে, এ রকমটা যেন না হয়। মনে রাখতে হবে, গাছের ডালপালা কাটলে আবার তা পুনর্বার গজাবেই। এ জন্য মূলোৎপাটন করতে হবে। মাদকের আন্ডারওয়ার্ল্ডের যারা ডন বা গডফাদার, মাদক সাম্রাজ্যের যাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, তারা সর্বদাই ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী হয়ে থাকে। আজ কিছু চুনোপুঁটিকে মেরে ফেললে কাল দশজন নিয়োগ দেবে গডফাদার মাদক বিক্রেতারা। জদু-মধুদের মেরে লাভ কী? কারণ মাদকের গদফাদাররা একদিনেই এসব শত শত জদু-ফদুদের তৈরি করতে পারে। তাই আগে গদফাদারদের বিচার করতে হবে। মাদক বিক্রেতারা যাদের আনুকূল্যে এ কারবার চালান, তাদের বিষয়ে কোনো রকম পদক্ষেপ না নিয়ে কেবল নির্বিচারে হত্যাকা-ের পথ বেছে নেওয়া ঠিক হবে কি? এ ধরনের কারবারের রাজনৈতিক আশ্রয়দাতাদের বিষয়ে সরকার কঠোর হতে না পারলে এখন যাদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের বিকল্প তৈরি হতে বেশি সময় লাগবে না।

জানা যায়, সন্দেহভাজনদের নির্মূল করাই হচ্ছে সরকারের মাদকবিরোধী নীতির মূল সুর। সম্প্রতি মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযানে ত্রিশের অধিক অভিযুক্ত ব্যক্তি নিহত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ৫০০ জনের নাম রয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ধারণা করা হচ্ছে, কঠোর ব্যবস্থার পরিণতি হিসেবে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের নিহত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষার পথ থেকে বিচ্যুত না হয়ে দেশের প্রচলিত আইনেই বিচার হওয়া উচিত। ক্রসফায়ারে মৃত্যু কোনো সমাধান নয়। এ জন্য দরকার যুগোপযোগী আইন ও কড়া নজরদারি। পুলিশের কাছেও তো লাখ লাখ ইয়াবা পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে, তাদের কি ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে? র‌্যাব যাদের মামলার লিস্ট দেখে ক্রসফায়ারে দিচ্ছে, সেই মামলা যে পুলিশ টাকা খেয়ে রজু করেনি এর প্রমাণ কী? পুলিশ মাসোহারা না নিলে কোনো মাদকের স্পট চলে? কিছুদিন আগে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে ৯ জন পরিদর্শক পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে ৭২ হাজার প্রার্থী আবেদন করেছিল। এ নিয়ে দেশব্যাপী হইচই পড়ে যায়। কারণ, এই মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চাকরি মানেই নাকি ঘুষ, দুর্নীতির মহা-উৎসব।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিশেষ ক্ষেত্রে খোদ সরকারই বিচারব্যবস্থায় আর ভরসা রাখতে পারছে না। জঙ্গি দমন ও মাদক দমনে তাই ক্রসফায়ারের মতো আইনবহির্ভূত ও সংবিধান পরিপন্থী পন্থার আশ্রয় নিতে হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য, মাদক বিক্রেতাদের পুলিশ বা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর গ্রেফতার করা মানে চাঁদাবাজি আর ৫৪ ধারায় কোর্টে চালান অথবা থানা থেকে রাজপুত্রের মতো বিদায়। মাদক আইনে কদাচিৎ তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হলেও আইনের ফাঁকফোকরে তাদের কারাবাসও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাই গ্রহণীয় নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপে ভরসা পাওয়া যায় না। কেননা, অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষ সাক্ষী দিতে ভয় পায়, ফলে ওই সমস্ত অপরাধী আইনের মারপ্যাঁচে ছাড়া পেয়ে আবার অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়।

মাদকের সর্বোচ্চ শাস্তি তো মৃত্যুদ- আছেই। এর পরও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বিশেষণের দরকার আছে কি? ‘রাষ্ট্র অনুমোদিত হত্যা’ এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা কেন? এই মিশন যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য হয়, তবে নিরাপরাধ মানুষ বা সরকার প্রতিপক্ষ কিলিংয়ের স্বীকার হতে পারে। ভিন্নমতের মানুষ, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা প্রযুক্ত হওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস আছে।

ঢাকা শহরের প্রতিটি থানা এলাকায় পুলিশের সহযোগিতায় মাদক বেচাকেনা চলে, এটা ওপেন সিক্রেট। আর কে মাদক বিক্রি করে পুলিশ জানে না, এ কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, খোদ রাজধানীর মুগদা থানারই সাত পুলিশ কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে মাদক কারবারিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। ওই সাত পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বেলাব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোরশেদ হোসেনকে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার, এর আগে রাজবাড়ী থেকে হাইওয়ে রেঞ্জের এসআই বেলাল হোসেন, নারায়ণগঞ্জ সদর থানার সহকারী উপপরিদর্শক সোহরাওয়ার্দী হোসেন, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার কনস্টেবল আসাদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া গত ২৬ এপ্রিল ইয়াবাসহ খিলগাঁও থানার এএসআই মজনু হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। এভাবে মাদক কারবারির সঙ্গে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা লিখতে গেলে বড় এক কিতাব হয়ে যাবে।

রাষ্ট্রসমর্থিত বেআইনি কর্মকা- সেই রাষ্ট্রের আইনি শাসনের দৈন্য প্রকাশ করে। আর কোনো বাহিনী যখন রাষ্ট্রের পক্ষ্যে বেআইনি কাজ করে, তখন তারা কিছুটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ সেই বেপরোয়া কর্মকা-ের শিকার হয়। রাষ্ট্রের উচিত, আইন ও বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও গতিশীল করা। তাহলেই যেকোনো অপরাধীর দ্রুত বিচার হবে। বিচারে অপরাধী উপযুক্ত সাজা পাবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist