অলোক আচার্য্য

  ২৫ মে, ২০১৮

মতামত

কক্ষপথে বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ইতোমধ্যেই নিজ কক্ষপথে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ স্যাটেলাইটের যুগে আমরা এখন পুরোপুরি অংশীদার। দেশের জন্য অনেক বড় একটি সাফল্য, একটি নতুন অগ্রযাত্রা, একটি নতুন অধ্যায়। বর্তমান সরকারের অনেক সাফল্যের মধ্যে এটি নিশ্চয়ই অন্যতম। প্রযুক্তির দিক থেকেও বাংলাদেশ যে অনেক এগিয়ে গেছে, এটা তারই প্রমাণ। তবে সমালোচকদের কাজ সমালোচনা করা। এই কাজ নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে। যারা সমালোচনা করছেন তাদের বোঝা উচিত যে, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্জন করতে হবে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে বঙ্গবন্ধু-১ আমাদের দেশকে সাহায্য করবে। আমরা বহুবিধ সুবিধা পাব এখান থেকে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্যোগের সময় নেটওয়ার্ক ভেঙে পরলেও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দুর্গতদের উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ সহজতর করা। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নজরদারি জোরদার করা। ২০টি ট্র্যান্সপন্ডার দিয়ে দেশের টিভি চ্যানেলগুলোর সেবা দেওয়া ও বাকিগুলো ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মূদ্রা আয় করা এবং দেশের দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেটসেবা পৌঁছানো। এ ছাড়াও আরো অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমরা বিশে^র ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের এলিট ক্লাবে যোগ দিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর নাম এখন মহাকাশে পৌঁছে গেছে। কিন্তু আমরা সমালোচনা করা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। ভালো কাজের মধ্যেও খুঁত বের করতে পিছপা হইনি। কোনো না কোনোভাবে খুঁত বের করতে পারলেই নিজেকে অনেক বড় মনে করি। যখন প্রথম দিন স্যাটেলাইটের যাত্রা স্থগিত হয়েছিল, তখনো নানা প্রপাগান্ডা শোনা গিয়েছিল। আবার পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সেই পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান সত্যি। সমালোচকদের মুখ আজ বন্ধ। তারা অন্য কোনো বিষয় খুঁজতে হয়তো ব্যস্ত। প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতিটা এমন হওয়া উচিত যে, ভালো কাজের জন্য প্রশংসা আর খারাপ কাজের জন্য সমালোচনা। কিন্তু উভয় কাজের খুঁত বের করার চেষ্টাটা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। একটু প্রাণ খুলে প্রশংসা করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না বরং বড়ই হয়। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতি হওয়া আমাদের দেশ নতুন এক সাফল্য স্পর্শ করেছে। পাকিস্তানিদের শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে। কিন্তু এত কিছুর ভেতরেও দেশ ক্রমোন্নতির দিকে ধাবিত হয়েছে। দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় যোগ হয়েছে নতুন একটি পালক ।

দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে। ক্রমোন্নতির এই ধারায় বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ অবশ্যই উন্নত দেশে পরিণত হবে। একসময় তলাবিহীন এই ঝুড়ির তলা আজ মজবুত। দেশের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি বেড়ে এক হাজার ৭৫২ ডলার হয়েছে। বেড়েছে আমাদের গড় আয়ু। এখন আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর। তাছাড়া প্রবৃদ্ধিও বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ উন্নতির সবকয়টি ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়ে চলেছি। বর্তমান সরকারের হাত ধরে আরো অনেক বড় বড় সাফল্য এসেছে। সেসব কাজের আগেও নানা সমালোচনা এসেছে। তারপরও সেই কাজ থেমে থাকেনি। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো পদ্মা সেতু। বাইরের দেশ যখন দুর্নীতির অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগে মুখ ফিরিয়ে নিল, তখনো বাংলাদেশ হাল ছাড়েনি। হাতে হাত রেখে পদ্মা সেতু তৈরিতে লেগে গেল। যারা হবে না, সম্ভব না বলে মুখ ফিরিয়ে হাসছিলÑ তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে, কাজ শুরু হয়ে গেছে। আজ সে স্বপ্ন অনেকটাই বাস্তাবায়নের পথে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন হবে এই পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলে। সমালোচকদের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। এবারও যখন সারা দেশ তাকিয়ে আছে কখন তাদের স্বপ্নের স্যাটেলাইট মহাকাশে পৌঁছাবে তখনো একদল ব্যস্ত থেকেছে কোথায় লোকসান হলো, তা হিসাব করতে। তারা এটা বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে গেল যে, এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এতে আমাদের লাভের লাভ কিছুই হবে না। কিন্তু মহাকাশে যাত্রা শুরুর পর তারাও চুপ হয়ে গেল। আজ থেকে ২০ বছর আগেও কি কেউ ভেবেছিল একদিন এদেশের সব ছেলেমেয়ে বিনামূল্যে পাঠ্যবই পাবে। সবাই বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই নিয়ে বাড়ি ফিরছে। এটা খুব বড় একটা অর্জন। এ রকম আরো অনেক অর্জন রয়েছে, যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। তবে আমরা যে সব সমস্যা মোকাবিলা করতে পারছি, তা কিন্তু না। আমাদের সমস্যা আছে।

তবে এই এগিয়ে চলা কেবল আর্থিক মাপকাঠিতে হলেই হবে না। আমাদের পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা আজ ভাবতে বাধ্য করছে যে আজ আমরা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি কি না। উন্নত দেশের বাসিন্দাদের মনমানসিকতাও উন্নত হতে হবে। সামাজিক ঘটনাগুলো আমাদের এই সাফল্যকে মøান করে দিচ্ছে। সমাজে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে সামাজিক আস্থাহীনতা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, ধর্ষণ, খুন, হিংসা, লোভ , দুর্নীতি, বেকারত্ব, মাদকাসক্তের সংখ্যা ও অবসন্নে ভোগা মানুষের সংখ্যা। মানুষে মানুষে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের দূরত্ব। আর এই দূরত্বের ফলে সমাজে বাড়ছে অপরাধের হার। বিশ^াস শব্দটিই আজ মানুষের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।

যখন পরিবারের সদস্যদের বন্ধনই হালকা হয়ে যাচ্ছে তখন সমাজ তো নড়বড়ে হবেই। আর প্রকৃত উন্নয়ন করতে হলে সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গঠনের দিকে নজর দেওয়া আবশ্যক। মুনাফার এই যুগে আমরা সবাই সবাইকে ঠকাতে ব্যস্ত থাকি। সেই ঠকানোর প্রক্রিয়ায় আমরা প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত রয়েছি। প্রত্যেকেই নিজের অবস্থান থেকে ঠকানোর চেষ্টা করছি। নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে বেশির ভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকি। এসব করতে গিয়ে সমাজে এক সুক্ষ চিড় ধরেছে। এখন আমরা চাইলেও সেই ক্ষত মুছতে পারছি না। বরং ক্রমেই সেই ক্ষত বড় হচ্ছে। প্রতিদিনের পত্রিকার দিকে চোখ রাখলে আমরা এসব সমাজের নেতিবাচক চিত্রের খবর পড়ি। সেই সঙ্গে কয়েক দশক আগের সেই শান্তির জীবন, নিশ্চিন্ত জীবন হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবন থেকে। ব্যস্ততাই যেন নিয়তি। মানুষ কেবলই ছুটছে। যন্ত্রমানবের মত ছুটছে। কোথায় থামবে, তার কোনো ঠিকানা নেই। তাই এভাবে গড় আয় না হয় বাড়ছে, গড় আয়ুও বাড়ছে, গড় শান্তির খবর কী? একদিকে বিশ^ায়নের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে উন্নতির চরম শিখরে চড়েছি, অন্যদিকে দুদন্ড শান্তির খোঁজে নিরন্তর ছুটে চলেছি। এইতো জীবন। পরিসংখ্যানের হিসেবে কত কিছুর ক্ষতিপূরণ খুব সহজেই হিসেব করে দেওয়া যায়।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের এই দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশের ঘামে ভেজা মানুষের দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। সমাজের নানা অসঙ্গতির চিত্র আমাদের চোখে পড়ে। আমাদের পাশ^বর্তী অনেক দেশেও বহু সামাজিক সমস্যা রয়েছে। তাই বলে তারা থেমে নেই। প্রতিবন্ধকতাকে ঠেলে সামনে না এগিয়ে যেতে পারলে থমকে দাঁড়াতে হয়। তাই আমাদের প্রতিবন্ধকতা থাকবে, সমালোচনা থাকবে। তবে লক্ষ্যে ঠিকই পৌঁছাবে। ঠিক আমাদের স্যাটেলাইটের মতো। আমরা আরো এগিয়ে যাব, এ কথাও নিশ্চিত। কিন্তু কেবল আর্থিক মুক্তি ঘটলেই সবকিছু হয় না। সামাজিক বিশৃঙ্খলা আমাদের এই উন্নতির প্রধান অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক মুক্তির পাশাপাশি প্রয়োজন শান্তির নিশ্চয়তা। তবে সেজন্য আমাদের অর্জনগুলোকে ছোট করার কোনো কারণ নেই। মহাকাশে যাত্রা শুরু হয়েছে। কেবল সমালোচনা দিয়ে এ যাত্রাকে থামানোর চেষ্টা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist