মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ২৫ মে, ২০১৮

নারী

বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান

নারী-পুরুষ একে অন্যের আবরণস্বরূপ। আবরণ মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, দুর্যোগ ও দুর্বিপাক থেকে রক্ষা করে, লজ্জা নিবারণ করে। তাই পোশাক-পরিচ্ছেদ মানুষের জীবন ধারণের জন্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি নারী-পুরুষ পরস্পরের জন্য অতীব জরুরি। একজন ছাড়া আরেকজন চলতে পারে না। বিপদ-আপদ, জরা-মৃত্যু ও দুর্যোগ-দুর্বিপাকে একজন আরেকজনের সহায়ক। একজন আরেকজনের প্রেরণাদানকারী। পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সহায়তাকারী। সান্তান লালন-পালনে সহযোগী। দুঃখ-কষ্টে একসঙ্গে ভোগকারী। কার্য সম্পাদনে সাহায্যকারী। মানব প্রজন্মের ধারাবাহিতাও উভয়ের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই প্রবাহমান। সুতরাং, একজন থেকে আরেকজনকে পৃথক করে কিংবা ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বরং পারিবারিক স্নেহ-মমতা, আদর-আপ্যায়ন, শান্তি-শৃঙ্খলা সান্তান গর্ভে ধারণ ও লালন-পালন ইত্যাদির দিক দিয়ে যদি বিচার করা হয়, তাহলে দেখা যাবে এসব বিষয়ে স্ত্রীর অবদান স্বামীর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি; যা কোনো সময়ই অর্থের মানদ-ে বিচার করা সম্ভব নয়।

স্বামী এবং তার সংসারের প্রতি স্ত্রীর এতকিছু অবদানের পরও স্বামী যখন স্ত্রীর কাছে বিয়ের সময় যৌতুক দাবি করে এবং বিয়ের পর নানা ধরনের নির্যাতন করে, তা যে কত বড় অন্যায়-অবিচার ও জুলুম তা অনেকেই ভেবে দেখেন না। এই অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসাটা দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্গত। একজন স্ত্রী সংসারে কী কী অবদান রাখছেন, তার মধ্যে যেগুলো অর্থনৈতিক মানদ-ে দেখানো সম্ভব তা তুলে ধরা এবং যেগুলো আর্থিকভাবে দেখানো সম্ভব নয় সেগুলোও চিহ্নিত করা সার্বিক বোঝাপড়ার জন্য অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে যদি এমন কোনো জরিপ চালানো হয় যে, কতজন স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে মোহরানার টাকা আদায় করেছেন, কতজন বোন ভাইয়ের কাছ থেকে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ নিয়েছেন, তাহলে আমরা একটি হতাশাব্যঞ্জক চিত্রই দেখব। যে স্বামী কথায় কথায় ভরণ-পোষণের খোটা দেয়, কতজন স্ত্রী স্বামীকে এ বিষয়ে তার ধর্মীয় দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সংসারে তার আর্থিক অবদান অংক কষে, হিসাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। যেসব নারী সংসারের শান্তির জন্য পুরুষদের সব ধরনের নির্যাতন বিনাবাক্যে মেনে নেন, তাদের ভাবতে হবে সংসারের শান্তি তার নির্যাতন সহ্য করার মধ্যে নিহিত নয়। শান্তি একতরফা হয় না। স্ত্রীর নির্যাতন সহ্যের কারণে স্বামীর শান্তি হলেও স্ত্রীর তো অশান্তি হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে। এ ধরনের একতরফা শান্তি কোনো শান্তি নয়। শান্তি হতে হবে সবার মধ্যে, সামগ্রিকভাবে আর তখনই শান্তি তার স্থায়িত্ব খুঁজে পেতে পারে। সংসার ও পারিবারে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। মনে রাখতে হবে অন্যায় নির্যাতন সহ্য করার মধ্য দিয়ে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করা হয়। ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় কোনোরূপ বাধা সৃষ্টি করাও অন্যায়। আর প্রতিটি অন্যায় কাজের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে জবাব দিতে হবে।

শিক্ষা-দীক্ষায় নারীরা পুরুষদের চেয়েও পিছিয়ে নেই। এমনকি ইসলামি শিক্ষায়ও নারীরা তাদের স্থান করে নিচ্ছে। তারপরও নারীরা তাদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার যথাযথভাবে ভোগ করতে পারছেন না। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র ঘরের মেয়েরা। যৌতুক নামক কালব্যাধি তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। যৌতুকের প্রতি দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের লোভ-লালসা বিবাহ-বিচ্ছেদ বা তালাকের হারও বাড়িয়ে দিয়েছে। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারলে অতি সহজেই ধর্মীয়ভাবে ঘৃণিত তালাকের অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়। এগুলো নারীর মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ করে; যা মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা লাভের বড় বাধা। বিয়ের মতো অবশ্য কর্তব্য ও পবিত্র দায়িত্ব পালনে পুরুষদের যেন কোনো দায় নেই। সবই যেন নারীর। নারীরাই যেন বিয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বিয়ে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও যেন এককভাবে নারীর। পুরুষদের কিছু করণীয় নেই। পুরুষদের এসব স্বেচ্ছাচারী কর্মকা-ের কারণে কারো শিশু এতিম হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে পিতৃস্নেহ থেকে। মাহরুম হচ্ছে নারী স্বামীর সোহাগ থেকে। পিতৃগৃহে কাটাচ্ছে অপমান ও লাঞ্ছনার জীবন। পিতৃস্নেহ বঞ্চিত কত শিশু ঝরে পড়ছে জীবন থেকে অথবা আশ্রয় নিচ্ছে পথে। বহু নারীর আত্মহত্যার পেছনেও রয়েছে যৌতুক, তালাক ও স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে।

মেয়েদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সর্বত্রই পুরুষদের আধিপত্য বিরাজমান। প্রকৃতগতভাবেও মহিলারা পুরুষদের তুলনায় দুর্বল। তাই পুরুষদের নির্যাতন ও লোলুপ দৃষ্টি থেকে মহিলাদের বাঁচতে হলে মেধা চর্চা এবং আর্থিক দিক দিয়ে পুরুষদের তুলনায় তাদের এগিয়ে যেতে হবে। শালীনভাবে পথ চলতে হবে। কাজকর্মে দেহ আচ্ছাদিত করে চলতে হবে। যারা স্বাবলম্বী তাদের না করা যায় নির্যাতন, না করা যায় অধিকার হরণÑ এটা সবাই জানে। এ জন্যই সবলরা দুর্বলদের কখনো সবল হতে দেয় না। কেউ কাউকে স্বাবলম্বী করে দেয় না। স্বাধীনতার মতো তা অর্জন করে নিতে হয়। এটি যেমন ব্যক্তির বেলায় সত্য, তেমনি রাষ্ট্র এবং নারী-পুরুষের বেলায়ও সত্য। ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করে যারা মহিলাদের স্বাবলম্বী হতে দেয় না, অর্থ উপার্জনে বাধা সৃষ্টি করে, তাদের জানিয়ে দিতে হবে, ইসলামের যে পাঁচটি রোকন, তা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। নারীদেরকে আল্লাহর কোনো ইবাদত থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কোনো পুরুষকে দেননি। স্ত্রী কিংবা বোন অথবা কোনো কন্যাকে রোজগারি হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা ইসলাম স্বামী বা কাউকেই দেয়নি। কেউ যদি এরূপ করে, তা হবে অনৈসলামিক ও অধিকার হরণ। তবে সে উপার্জনের মাধ্যম হতে হবে হালাল ও জায়েজ পন্থায়।

সুতরাং, নারী নির্যাতনকারী ঘৃণ্য প্রথা যৌতুক, কথায় কথায় তালাক ও অপ্রয়োজনীয় একাধিক বিয়ে থেকে নারীদের রক্ষা পেতে হলে রোজগারি হতে হবে, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ও সচ্ছল হতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের গার্হস্থ্য কাজকর্ম এবং সন্তান জন্ম, লালন-পালনেরও যে আর্থিক মূল্য আছে তা তুলে ধরতে হবে। কারণ, নারীদের বাদ দিয়ে মূলত সুখ শান্তি তো নয়ই, কোনো কল্যাণও সম্ভব নয়। কেননা, নারীরা হলো বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান। নারী হচ্ছে স্বামীর জীবনসঙ্গী কিংবা সহধর্মিণী। কোনো ভোগ্যপণ্য কিংবা বিজ্ঞাপনী মডেল নয়। বরং পারিবারিক এবং সামাজিক ঐক্য ও সংহতির মডেল।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist