জি. কে. সাদিক

  ২৪ মে, ২০১৮

নারী নির্যাতন

সাংস্কৃতিক পরিশুদ্ধি প্রয়োজন

মানবাধিকারকর্মী ও ব্রিটিশ রাজবধূ মেগান মার্কেল বলেছেন, পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে নারী। সুতরাং তাদের কথা সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকদের কাছে পৌঁছাবে না, সেটা হতে পারে না। সম্প্রতি নারী অধিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আলোড়ন ও আন্দোলন চলছে, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে মেগানের কথাটি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। বিশেষ করে যখন পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায় বা যানবাহনে নানা ধরনের হয়রানি, শ্লীলতাহানি ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর ভিকটিমের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু মানুষকে প্রতিবাদ করতে দেখা গেলেও অধিকসংখ্যক মানুষ নীরব থাকে এবং প্রতিবাদ হলেও এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ হচ্ছে না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মেগানের কথাটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। নারীর প্রতি এমন দুরাচার বারবার ঘটছে, তবু ভিকটিমের বেদনা-আর্তি আমাদের মানসিকতাকে প্রভাবিত করছে না। এ ক্ষেত্রে আইনও যথাযথ কাজ করতে পারছে না। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রকাশিত তথ্য মতে, ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা জেলার পাঁচটি ট্রাইব্যুনালে ৭ হাজার ৮৫৪টি ধর্ষণ মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২ হাজার ২৭৭টি। সাজা হয়েছে ১১০টি মামলার। অর্থাৎ ৩ শতাংশের কিছু কম। আর ৯৭ শতাংশ মামলায় আসামি ছাড়া পেয়েছে। ৯৭ শতাংশ মামলার মধ্যে ৪১ শতাংশ আসামি বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে। ৫৫ শতাংশ মামলায় সাক্ষ্য শুনানি শেষে আসামিরা ছাড়া পেয়েছে। বিচার হওয়া ৩ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৪৫ ভাগ আসামির। উপরোক্ত সমীকরণের আলোকে এটা প্রমাণিত, আমাদের দেশের আইন ধর্ষণ রোধে যথেষ্ট নয়। যদি বলা হয়, আইনিব্যবস্থা যুগোপযোগী করলে ধর্ষণ রোধ সম্ভব, তাহলে সে ক্ষেত্রে দ্বিমত অধিক জোরালো হয়। কারণ বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ নারী কোনো না কোনোভাবে নির্যাতন বা যৌন হয়রানির শিকার। নারী নির্যাতনের ঘটনা পরিমাণে ইউরোপের দেশগুলোয়ই বেশি। তাদের দেশের আইন আমাদের দেশের চেয়ে অধিক শক্ত ও যুগোপযোগী। তবু সেখানে নারী নির্যাতন বন্ধ হয়নি।

তাহলে, কীভাবে নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব? এর কোনো সরাসরি উত্তর নেই। কারণ যেভাবে লাগামহীন নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, এটা সমাজের সমাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রমাণ। আর এ অবক্ষয় শুধুই আইন প্রয়োগ করে বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ আইনি শাসনের মাধ্যমে মানুষকে সব সময় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। আবার আইনের প্রয়োগ যথাযথ না হলে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে যায়। মানুষ যখন অপরাধ করে, তখন তার মনে আইনের ভয় খুব অল্পই থাকে। অন্যদিকে কম-বেশি সব দেশেই প্রভাবশালীরা আইনকে ক্ষমতাবলে প্রভাবিত করে। তাই এখানে আইন অনেকটাই হাতবাঁধা। আর আইনের মাধ্যমে সব সময় সময়োপযোগী কাজ করা সম্ভব হয় নয়। সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অনেক অপরাধীই পার পেয়ে যায়। বিশেষ করে যাদের ক্ষমতা আছে, তারা সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করতে পারে। অনেকে ভয়ে সাক্ষ্য দিতে চায় না। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজও অনেক সময় ক্ষমতা বা অর্থের জোরে হারিয়ে যায়। তখন ঘটনা সত্য হলেও আইন কিছুই করতে পারে না। তবে আইনকে যুগোপযোগী করে তৈরি করতে হবে এবং আইনি সমতা বজায় রাখে বৈষম্যহীনভাবে, তা প্রয়োগ করতে না পারলে অবক্ষয় আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। আমি নারী নির্যাতনরোধে আইনকে শেষ ধাপে রাখি। শেষ চিকিৎসা হিসেবে আইন আশ্রয়স্থল হতে পারে। যদি এমন কিছু করা যায়, যা আইন প্রয়োগের মতো জটিলতায় না পড়তে হয়, তাহলে সেটাই উত্তম। নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হলে আগে আমাদের সমাজব্যবস্থার পটপরিবর্তন করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও সংস্কৃতিই হতে পারে প্রধান হাতিয়ার।

শিক্ষা একজন মানুষের ব্যবহার, রুচিবোধ, আচার-আচরণ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। শিক্ষা বলতে প্রাতিষ্ঠানিক গ-ির মধ্যে সিলেবাস-সর্বস্ব কিছু বই পড়াই নয়। সাক্ষরতা আর শিক্ষা দুটি ভিন্ন বিষয়। শিক্ষা মানুষের ভেতরে সুপ্ত থাকা বিবেককে জাগিয়ে দেয়। তখন মানুষ আবেগ থেকে মুক্ত হয়ে বিবেকের তাড়নায় পরিচালিত হয়। ব্যক্তির কথায়, আচরণে অন্য কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হয় না। আর এটা তখনই সম্ভব যখন শিক্ষায় নৈতিকতার সংশ্লেষ ঘটে। তাই শিক্ষা শুধুই জীবিকার হাতিয়ার নয়, শিক্ষা দেশপ্রেম, নৈতিকতার জাগরণ ও লালন সত্য সুন্দর আদর্শ ধারণ করে মানবতাবাদী হয়ে উঠতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেমন দায়িত্ব, তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব হলো পরিবারের। কারণ একটি শিশু অনৈতিক চরিত্র নিয়ে জন্মায় না। সে যদি জন্মের পর নৈতিকতা ভিন্ন কিছু স্পর্শ না করতে পারে, তাহলে অনৈতিক কর্ম সে শিশুর দ্বারা সম্ভব নয়। সুতরাং, প্রত্যেক পরিবারকে সন্তানের ব্যাপারে সচেতন হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

সহজ ভাষায় বললে, সমাজের মানুষের পরিশীলিত রুচিবোধ, আচার-আচরণ ও কর্মই হলো সংস্কৃতি। যখন সমাজের মানুষের রুচিবোধ, আচার-আচরণ ও কর্ম অবক্ষয়কবলিত হয়, তখন সংস্কৃতিও অবক্ষয়কবলিত হয়। এভাবেও বলা যায়, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় শুরু হলে মানুষের চরিত্রেও অবক্ষয় শুরু হয়। যখন সামষ্টিক চরিত্রের পতন হয়, তখন সংস্কৃতিরও পতন ঘটে। সে সময় ব্যক্তি চরিত্র আর ঠিক থাকে না। সংস্কৃতি যেমন মানুষের সৃষ্টি, তেমনি সংস্কৃতি মানুষকে নিয়ন্ত্রণও করে। আমরা যখন একটা সামাজিক ও শিক্ষণীয় ফিল্ম দেখি, তখন তা মনে মনে আয়ত্ত করে রাখি; বাস্তব জীবনে কাজে লাগাই। কিন্তু আমরা যদি এমন কিছু দেখি বা পড়ি, যা আসলে শালীনতাবহির্ভূত বা আমাদের সমাজের সুস্থ সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই না, তখন আমার সেটা মনের অজানাতেই ধারণ করে রাখি। ক্রমেই এ ধারণা যখন বেশি হয়, তখন আমরা সেদিকে প্রভাবিত হই। আর যখন সেটা বাস্তব জীবনে কামনা করি, বিপত্তিটা তখনই ঘটে। তাই আমাদের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে হবে। তা না হলে ব্যক্তি চরিত্র ও মানস পতনের মাধ্যমে সামাজিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করবে। আমাদের শিক্ষাকে জাতীয় মানস চেতনার আলোকে সাজা থেকে এবং সংস্কৃতিকে অবক্ষয় ও আগ্রাসনমুক্ত রাখতে হবে।

মানুষ ভুল করবেই। সমাজে যখন শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে মানবিক ও নৈতিক মানস গঠনে ভূমিকা রাখবে, তখন প্রজন্ম পরম্পরায় সমাজে থেকে অবক্ষয়ের রেখা বিলুপ্ত হবে। অপরাধের মাত্রাও কমে আসবে। আর মানুষ বিবেকতাড়িত হয়ে কাজ করলে অপরাধের সম্ভাবনা নিতান্তই কম। আইন সব সময় অপরাধ দমনের জন্য যথেষ্ট নয়। আইনের কিছু দুর্বলতা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। আর সব সময় শাসনের মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কারণ মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। সুতরাং সে স্বাধীনতার শক্তিকে নৈতিক পথে পরিচালিত করলে অনৈতিকতা সমাজে বেপরোয়া হতে পারবে না। সে সময় নারীদের কথা সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষের কানে পৌঁছাবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist