রায়হান আহমেদ তপাদার
বিশ্লেষণ
গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিচার
স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক বছর পর থেকেই মিয়ানমার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরু হয়। সত্তরের দশকে যা প্রকট আকার ধারণ করে। যখনই রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জুলুম-নির্যাতন শুরু করেছে, তখনই রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করছে এ দেশ। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোয়ও আশ্রয় নিচ্ছে তারা। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বলছে, এখনো রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আগুন জ্বলছে। সারা বিশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞ থেমে নেই। মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে (আইসিসি) মিয়ানমারের বিচার সম্ভব বলে জানিয়েছেন আইনজ্ঞরা। যেকোনো রাষ্ট্র, সংগঠন এমনকি কোনো ব্যক্তিও আইসিসির কাছে বিচারের আবেদন করতে পারেন। চলমান গণহত্যা, ধর্ষণের সঙ্গে ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গা নির্যাতন ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা চালানোর অধিকার বাংলাদেশের আছে কি নাÑসে বিষয়ে বাংলাদেশের অভিমত জানতে চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। নেদারল্যান্ডসের হেগভিত্তিক আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। এ বিষয়ে ৮ জুনের মধ্যে প্রকাশ্যে বা গোপনীয়ভাবে অভিমত জানানোর অনুরোধ জানানো হয়।
স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ১৮ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি, বিভিন্ন প্রামাণ্য দলিল ও সাক্ষ্যগ্রহণের ভিত্তিতে ২২ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রায় দেন আন্তর্জাতিক গণ-আদালত। যেখানে মিয়ানমারের ওপর অবিলম্বে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মিয়ানমারের সরকারি পদে থাকা ব্যক্তিদের বিদেশে থাকা ব্যাংক হিসাব বাজেয়াপ্ত, মিয়ানমারের বাইরে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কথা হচ্ছে, এই আহ্বানগুলো কেউ কি কানে তুলেছেন বা বাস্তবায়ন করেছেন বা করতে পারবেন? এই রায়ের ফলে মিয়ানমারের কী হয়েছে বা তারা কি এই রায়কে আদৌ ভয় পেয়েছে? এই রায়ের মধ্য দিয়ে কি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হয়ে গেছে বা সে পথে কোনো অগ্রগতি হয়েছে? অনেকে এভাবে ভাবতে চান, প্রতীকী বিচার হলেও এর মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে জনমত, তা কিছুটা বেড়েছে এবং এতে দেশটির ওপরে আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক চাপ বেড়েছে। বেড়েছে বলেই তাদের একজন মন্ত্রী সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন এবং বলেছেন, তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চান। পক্ষান্তরে এটিও বাস্তবতা যে, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের বলেছেন, রোহিঙ্গারা তাদের জন্য নির্ধারিত এলাকার বাইরে যেতে পারবে না। মানে হলো, কিছু রোহিঙ্গাকে তারা নামকাওয়াস্তে ফেরত নিলেও তাদের রাখা হবে এক রকম জেলখানায়। সর্বদা সশস্ত্র পাহারায়। সুতরাং এ রকম একটি বিভীষিকার মধ্যে রোহিঙ্গারা কেন যাবে? তার চেয়ে বাংলাদেশের ক্যাম্পেই তো তারা নিরাপদ।
দেশটির বিরুদ্ধে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউশন বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে পারে। তদন্তকালে ওই গণ-আদালতের রায়, গণমাধ্যমের ছবি ও ভিডিও রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারে প্রসিকিউশন। এরপর আইসিসিতে মামলা হলে সেই আদালতও এগুলো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। কেনিয়াসহ কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে আইসিসির এমন তদন্ত কার্যক্রম এখন চলছে। রোহিঙ্গা নিধন প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আইনজ্ঞরা এসব কথা বলেন। তারা বলেছেন, মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায়ের আইনগত ভিত্তি না থাকলেও এর প্রভাব রয়েছে। এ রায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশ্বে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। তারা আরো বলেছেন, যদিও গণ-আদালতে প্রতীকী বিচার হয়েছে, বিচারকরা প্রতীকীভাবেই আইসিসির বিধানগুলো অনুসরণ করেছেন, এর উদ্দেশ্য ছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল যাতে আন্তর্জাতিক আইনের বিধানগুলো অনুসরণ করে সু চিসহ মিয়ানমারের নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, এ গণ-আদালতের রায়ের আইনগত ভিত্তি না থাকলেও এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত সৃষ্টিতে ও প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। যেখানে গণহত্যার বিচারের জন্য একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত আছে, সেখানে আন্তর্জাতিক বিশ্বের উচিত সেই স্থায়ী আদালত অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মিয়ানমারের নেতাদের বিচারের জন্য চাপ সৃষ্টি করা।
মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের বিচারের জন্য রুয়ান্ডার মতো ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে বলে মনে করেন অনেকেই। এদিকে মালয়েশিয়ার গণ-আদালতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক অংশ নিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে বলেছেন, মিয়ানমারের নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতনের কারণে জাতিসংঘ, আসিয়ান, ওআইসিসহ বিশ্বের অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান যেন মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। যাতে এই নির্যাতন বন্ধ হয় এবং যেসব নাগরিক বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে, তাদের যেন নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। বলা হয়, রোহিঙ্গা ইস্যুটি যেহেতু এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চালাচ্ছে বলে খোদ জাতিসংঘও স্বীকার করেছে, সুতরাং আইসিসির পক্ষে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এর অনুসন্ধান করা সম্ভব। কেননা নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়ে জুলেশন পাস হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেউ কেউ অবশ্য এমনও মনে করেন, বাংলাদেশের আইনেও মিয়ানমারের বিচার করা সম্ভব। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারে কোনো ঘটনার বিচার করতে হলে অপরাধটি বাংলাদেশে সংঘটিত হতে হবে বলে বিধান থাকলেও আইনের সর্বজনীন এখতিয়ারও রয়েছে।
মিয়ানমারে কথিত গণতন্ত্রের নেত্রী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ক্ষমতায় থাকলেও আদতে দেশ চালায় সেনাবাহিনী এবং সু চি মূলত তাদের ক্রীড়নক? সুতরাং এ রকম একটি সেনা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের সেনাপ্রধান বা সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকর্তা বা সদস্যকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত দোষী সাব্যস্ত করবে আর মিয়ানমার সেই বিচারের রায় কার্যকর করবে, আপাতত এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। মিয়ানমারে সরকার পরিবর্তন হয়ে পুরোদস্তুর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলেও রোহিঙ্গা নিধনের দায়ে তাদের বিচার করা কঠিন হবে। কারণ সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষই রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আইসিসির প্রসিকিউশন টিমকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানানো যেতে পারে। বিচারের পাশাপাশি বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করতে পারে। আইন বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায়ে মিয়ানমার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর দেশটির বিরুদ্ধে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউশন বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে পারে।
রোম স্ট্যাটু অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ১৩ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের পাশাপাশি মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে সুপিরিয়র রেসপন সিবিলির দায়ে অভিযুক্ত করা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন গণহত্যা নিয়ে কাজ করছেন এমন গবেষকরা। রোম স্ট্যাটু অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট ১৯৯৮-এ বলা হয়েছে, ‘যেসব সদস্য দেশ রেকটিফাই করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হয়েছে, তারা যদি এ ধরনের কোনো অপরাধ সংঘটিত করে, তাহলে তাদের বিচার আইসিসি করতে পারবে। কিন্তু মিয়ানমার রেকটিফাই করেনি। তবে আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ক্ষেত্রেও উপায় আছে। নিরাপত্তা পরিষদ একটি রেজ্যুলেশন পাস করে সরাসরি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টকে বিচারের জন্য বলতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। যেহেতু মিয়ানমার নির্যাতন করে তাদের নাগরিকদের আমাদের দেশে পাঠিয়েছে, সেহেতু ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে গিয়ে রোহিঙ্গাদের খাবার, আশ্রয়, ভরণপোষণ চেয়ে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে বাংলাদেশ। কেবল ফিরিয়ে নিলেই হবে না, হাজার হাজার মানুষ হত্যার দায়ে মিয়ানমারকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেছেন, ‘এ ধরনের গণহত্যার বিচারের জন্য বিশ্বে একটি স্থায়ী আদালত আছে। রোম স্ট্যাটু অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট ১৯৯৮-এর অনুচ্ছেদ ১৩ অনুযায়ী আইসিসিতে মিয়ানমারের বিচার করা সম্ভব।’
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
"