মো. মঈনউদ্দিন

  ২৩ মে, ২০১৮

মতামত

সম্পর্কে চীন ও রাশিয়া

সময় এক বৃদ্ধ যাযাবর। কবির দৃষ্টিতে বৃদ্ধ যাযাবরখ্যাত সময় তার স্থান পরিবর্তন করেছে ক্ষণে ক্ষণেই। সুখের প্রতীক পায়রার মতো সময় কখনো অবস্থান করেছে ইংল্যান্ডে, কখনো রোমে, কখনো রাশিয়ায় আবার কখনোবা আমেরিকায়। সময় নামক বৃদ্ধ যাযাবর বেশিদিন এক জায়গায় অবস্থান করতে পছন্দ করে না। তেমনি রাজনৈতিক কলাকৌশলও ক্ষণে ক্ষণেই তাদের জায়গা পরিবর্তন করে। কখনো এর হাতে তো কখনো ওর হাতে লাফিয়ে বেড়ায় ঘাসফড়িংয়ের মতো। বৈশ্বিক রাজনীতিতে কয়েক বছর ধরে মেরূকরণের হাওয়া শুরু হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় পশ্চিম (মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ) বনাম চীন রাশিয়ার প্রতিযোগিতা ক্রমেই প্রকটতর হচ্ছে। ধীরে ধীরে পশ্চিমের অপ্রতিরোধ্য শক্তি নিয়ে এসব দেশে বাড়ছে অসন্তোষ। এশিয়া মহাদেশে পশ্চিমা শক্তির প্রতি উভয়ের অভিন্ন অসন্তোষকে কেন্দ্র করে এক দশক ধরে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্কের প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে। অভিন্ন মনোভাব নিয়ে উভয় দেশই এসেছে পরস্পরের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা বাড়িয়েছে। বলা যায়, দুদেশই সংগতিপূর্ণ অর্থনীতি অব্যাহত রেখেছে। রাশিয়া চীনে হাইড্রো-কার্বন ও অন্য সম্পদ সরবরাহ করছে, যা চীনাশিল্প খাতে শক্তি জোগাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি বিবেচনা করে রাশিয়া ও চীন উভয় দেশই তথাকথিত পশ্চিমা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ধারণা জলাঞ্জলি দিয়েছে। এখন উভয়ই নিজেদের অব্যবহিত নিকটবর্তী অঞ্চলে পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে যেকোনো পশ্চিমা সামরিক শক্তির উপস্থিতি সীমিত করতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া চাইছে পূর্ব ইউরোপে দেশটির প্রভাব বাড়াতে, চীন চাইছে দক্ষিণ চীন সাগরে নিজের শক্তি সংহত করতে এবং সর্বোপরি উভয় দেশই চাইছে পুরো মধ্য এশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য জোরদার করতে। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কে চির ধরার পর দেশটি বিশ্বমহলে অনেকটা একঘরে হয়ে গেছে। এটি রাশিয়াকে বেইজিংয়ের সঙ্গে অধিকতর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ভূমিকা রেখেছে। তবে তাদের সম্পর্ক এখনো ঐতিহাসিকভাবে চিহ্নিত ‘অনিরাপত্তা ও আস্থাহীনতার’ বাধা অতিক্রম করতে পারেনি। বরং এই একটি কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্কোন্নয়ন সত্ত্বেও এখনো বেইজিং ও মস্কোর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যহীতা বিদ্যমান। বিশেষত দেখা যায়, মধ্য এশিয়ায়, যেখানে চীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সফট পাওয়ার ভূরাজনৈতিক চিত্রে ব্যাপক রূপান্তর ঘটাচ্ছে। গত দশকজুড়ে মধ্য এশিয়ার পাঁচটি রাষ্ট্রে চীনা বাণিজ্যের স্ফীতি ঘটেছে। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সাল নাগাদ ওইসব রাষ্ট্রে চীনা বাণিজ্য ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যেখানে একই সময়ে রাশিয়ার বাণিজ্য কেবল ১৮ বিলিয়নেই স্থবির হয়ে রয়েছে। রাশিয়ার দিক থেকে এটি খুব একটা বাড়ার লক্ষণও নেই। ইউরেশিয়ায় রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে নতুন ‘বড় খেলার’ বাগাড়ম্ব^রতা সত্ত্বেও পশ্চিমা দেশগুলো নয়, একা চীনই মধ্য এশিয়ার তেল ও গ্যাস রফতানিতে রাশিয়ার একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙেছে। ইউরোপের বাজারে চীনা পণ্য পাঠানোর প্রধান পরিবহন বেল্ট হচ্ছে কাজাখস্তান। তাই কৌশলগত অবস্থানের কারণে চীনের জন্য কাজাখস্তানের সঙ্গে সম্পৃক্তি দরকার। কাজেই আপন স্বার্থের বাস্তবিক প্রয়োজনেই চীন মধ্য এশিয়ায় নিজেদের বলিষ্ঠ উপস্থিতি নিশ্চিত করছে। এ ক্ষেত্রে অস্বস্তি সত্ত্বেও অভিন্ন পশ্চিমাবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে দেশটি রাশিয়াকে মিত্র হিসেবে পেতে চাইছে। মনে হচ্ছে, মধ্য এশিয়ায় চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য কিংবা আঞ্চলিক নেতাদের বেইজিংকে স্বাগত জানানোর বিষয়টি সম্পর্কে রাশিয়া খুব একটা চিন্তিত নয়। সম্ভবত মস্কো জানে, ওই অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি খর্ব করতে দেশটির তেমন কিছু করার নেই। দেশটির স্থবির অর্থনীতি রাশিয়াকে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্য সীমিত করে দিয়েছে। ইউক্রেনের ঘটনার জেরে পশ্চিমা অর্থনৈতিক অবরোধের শিকার হওয়ার পরে বেইজিংয়ের ওপর রাশিয়ার বর্ধমান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নির্ভরতার কারণেও মস্কো নিজ সামর্থ্যে ফিরে আসার শক্তি হারিয়েছে। ভেতরে ভেতরে হয়তো মধ্য এশিয়ায় চীনের প্রগাঢ় সম্পৃক্তির বিষয়টি ভালো চোখে দেখছে না দেশটি, কিন্তু নিজ সামর্থ্য সম্পর্কে সজাগ থেকে স্বাভাবিক কারণেই রাশিয়া চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব অনেকটা দমিয়ে রেখেছে। অস্বীকারের উপায় নেই, চীনও সন্তর্পণে সুকৌশলে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করছে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়াকে উত্তেজিত করার তাদের কোনো আপাত অভিপ্রায় নেই। তাই তো চীন রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতো ‘আঞ্চলিক শক্তি’ হিসেবে খারিজ করে দেয়নি; বরং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বৈশ্বিক নেতা হওয়ার পুতিনের বাসনাকে গভীরভাবে আমলে নিয়েছেন। সরকারি পর্যায়ে দুদেশের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে শি পুতিনকে প্রতি বছরই বহু শীর্ষ বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান; যদিও তাদের আলাপ শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন ইনিশিয়েটিভের (ইইইউ) সঙ্গে বিআরআই সমন্বয়ের অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতিতে পর্যবসিত হয়। এসব প্রতিশ্রুতি অবশ্য বাস্তবে রূপদান প্রায় অসম্ভব। কারণ বিআরআই ও ইইইউ পারস্পরিকভাবে মোটেই সংগতিপূর্ণ নয়। বিআরই হলো বিভিন্ন দেশের বাজারে সংযোগ স্থাপন এবং বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায় চীনকে প্রধান ইঞ্জিন হিসেবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার রূপকল্প। অন্যদিকে ইইইউ হলো ইউরোপ ও চীন উভয় শক্তির অব্যাহত কব্জা থেকে পরিত্রাণ দেওয়ার নামে আলোচ্য অঞ্চলে মধ্য এশিয়ায় মস্কোর প্রভাব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে একটি একক বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা। ব্যাপক রাজনৈতিক বাস্তবতার বিপরীতে সীমিত সম্পদের কারণে চীনের চেয়ে রাশিয়া তুলনামূলক কম আকর্ষণীয় বিকল্প। অন্তর্ভুক্তিমূলক বিআরআই কাঠামোর বিপরীতে ইইইউ কিছু বাধ্যগত (পড়ুন নিগৃহীত) সদস্য রাষ্ট্র ও পৌনঃপুনিক বাণিজ্যযুদ্ধের একটি অসুখী সংঘ। চীনের বর্ধমান শক্তি সম্পর্কে রাশিয়ার সংবেদনশীলতার প্রতি সজাগ থেকে বেইজিং খুব দক্ষতার সঙ্গে আলোচ্য অঞ্চলে শক্ত নিরাপত্তা পদচিহ্ন উন্নয়নে যেকোনো তড়িৎ পরিকল্পনা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে। এ কৌশলে ঐতিহ্যগতভাবে চীন রাশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। ওই অঞ্চলে শক্ত উপস্থিতির পরিবর্তে অধিকতর ‘সফট’ নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে নিজেদের ভূমিকা জারি রেখেছে চীন এবং দেশটি এ ভূমিকাটি বহুলাংশে পালন করছে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও অর্থায়নসংক্রান্ত নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে। তবে ধীরে ধীরে আলোচ্য অঞ্চলে অধিকতর সক্রিয় নিরাপত্তা ভূমিকা রাখার ইঙ্গিত দিচ্ছে চীন। মনে রাখতে হবে, মধ্য এশিয়াই হলো রাশিয়া-চীন উভয়ের জন্য শেষ বাফার জোন, যেখানে অস্থিতিশীলতা বিরাজমান। এ অস্থিতিশীলতা মুসলিমবিশ্বে যখন ছড়িয়ে পড়ছে, তখন রাশিয়ার নিরাপত্তা খাত বহু সামরিক সংঘাত দ্বারা বিদীর্ণ। সেদিক থেকেও ওই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনতে রাশিয়ার খুব একটা কিছু করার নেই। এ ক্ষেত্রে চীন বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কাজেই এটিও চীনের জন্য ওই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি বাড়ানোর মোক্ষম সময়। এদিকে তাজিক-আফগান সীমান্তে চীন একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করছে, যা উভয় দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আবার চীনা দূতাবাসে ২০১৬ সালে বোমা হামলার পর চীন কিরগিজস্তানেও অনেকটা চুপিসারে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়িয়েছে। তুর্কমেনিস্তানেও তারা অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। ওই চার দেশে চীনের গভীর স্বার্থ রয়েছে, সাধারণত যাদের ওই অঞ্চলে সবচেয়ে কম স্থিতিশীল মনে করা হয়। মজার বিষয় হলো, এর মধ্যে তিনটি দেশেরই (কাজাখস্তান, আফগানিস্তান ও কিরগিজস্তান) চীনের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। আবার তুর্কমেনিস্তান চীনের কাছে ব্যাপকভাবে দেনাগ্রস্ত এবং চীনের প্রধান গ্যাস সরবরাহকারী দেশও এটি। মোদ্দাকথা হলো, মধ্য এশিয়ায় রাশিয়া-চীনের অংশীদারিত্ব সাধারণত এখনকার মতো স্থিতিশীল থাকবে। রাশিয়ার প্রতি চীনের সুচতুর ও নিপুণ কূটনীতি উভয় রাষ্ট্রেরই পশ্চিমা বলয় থেকে বের হওয়ার অভিন্ন বাসনা রয়েছে। রুদ্ধ দ্বারের পেছনে উভয় দেশের উত্তেজনা জিইয়ে রেখেছে। তবে সারা বিশ্বে চীন তার নিরাপত্তা প্রভাব শক্তিশালী করার প্রয়োজন ক্রমেই অনুভব করায় এটি অস্পষ্ট যে, এ স্থিতিশীলতা আর কতকাল স্থায়ী হবে। সময়ই এ ক্ষেত্রে প্রধান নির্ণায়ক। অনাগত সময়ই বলে দেবে মধ্য এশিয়া ও বহির্বিশে^ রাশিয়া-চীনের অভিন্ন অংশীদারিত্ব শেষ পর্যন্ত কোনদিকে গড়াবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist