শফিকুল ইসলাম খোকন
ধর্ম
হাফেজদের স্বীকৃতি প্রয়োজন
আঠারো হাজার মাখলুকাতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ জাতি আমরা। আর সেই শ্রেষ্ঠ মানবজাতির মহাগ্রন্থ হলো পবিত্র আল-কোরআন। এমন একটি গ্রন্থ যে যার একটি দাঁড়ি, কমাও বাদ দেওয়ার কারো শক্তি নেই। আমরা কোরআনপ্রেমী। আল-কোরআনকে সম্মান করি। আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থ তাও মানি। এসব কথা প্রতিটি মুসলমানের কথা, একেবারে হৃদয়ের কথা। মন-প্রাণ, বিশ্বাসের কথা। তাই নিজে কোরআনুল কারিম পড়তে পারুক আর না-ই পারুক, অন্তত তার ছেলেমেয়েদের এ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করতে চান না কোনো অভিভাবক। অত্যন্ত ভালো চিন্তা, আমরা অভিনন্দন জানাই ওই সব অভিভাবককে; যারা এ চিন্তা, বিশ্বাসটুকু মনের ভেতরে লালন করেন। কারণ আমাদের সমাজের অনেকে মনে করেন নামাজ, রোজা, কোরআন পড়া হুজুরদের কাজ। আমরা তো আর মাদরাসায় পড়িনি; তাই এ কাজ আমাদের না। কিন্তু কখনো কি চিন্তা করেছেন আপনাকেও মরতে হবে? একজন আল্লাহর ওলিকে কবরে যে প্রশ্ন করা হবে, সেই প্রশ্ন আপনাকেও করা হবে। আল্লাহ অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিচারক। চুল পরিমাণ কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। কোনো ধরনের খোঁড়া অভিযোগের মূল্য আল্লাহর কাছে নেই। আমরা সেই কোরআনকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো মূল্যায়ন করছি না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজিকে প্রাধান্য দিচ্ছি। কোরআনকে রাখা হচ্ছে ‘ফোর সাবজেক্ট’। অথচ এই কোরআনকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাখার কথা প্রথম পর্যায়ে।
রমজান মাস এলেই হাফেজদের কদর বেড়ে যায়। বাকি ১১ মাস তাদের কোনো খোঁজখবর রাখছি না। একজন কোরআনের হাফেজ হতে হলে অনেক কষ্ট করতে হয় এবং সংরক্ষণের জন্য দুনিয়াবি ফেতনা-ফছাদ থেকে দূরে থেকে আমল-আখলাক ঠিক রেখে চলতে হয়। কখনো কি ভেবেছি সেই হাফেজ সাহেবদের কথা? যিনি আমার জীবন বিধান কোরআন তথা ইমান ইসলাম রক্ষার জন্য সারাজীবন পার করে দিলেন আমরা তাদের জন্য কী করেছি। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র কী করতে পেরেছে। পারেনি; সমাজ নয় রাষ্ট্রও কিছুই করেনি। শুধু রমজান মাসে মুখের ভালোবাসা দিয়ে ক্ষ্যান্ত। আমরা দাবি করি, আমাদের দেশ ৯০ ভাগ মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু কই তথাকথিত নামধারী ৯০ ভাগ মুসলিম রাষ্ট্র কী করেছে তাদের জন্য? এ দেশে স্বপ্নচূড়ায় ওঠার জন্য পুরস্কৃত করা হয়, এ দেশে ছয়-চার মারার জন্য কোটি টাকার বাজেট পাস হয়। কিন্তু কোরআনের হাফেজদের জন্য কেউ কিছু করেছে বলে মনে হয় না। কেমন মুসলমানের দেশ আমার বাংলাদেশ? এ দেশে সেরা সুন্দরী পুরস্কার ঘোষণা করা হয়, সেরা অভিনেতা, সেরা নায়ক আর গায়কদের পুরস্কৃত করা হয়, কিন্তু যে হাফেজে কোরআন খেয়ে না খেয়ে মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন শরিফ সংরক্ষণ করে চলছে, তাদের জন্য আমাদের কী কিছুই করার নেই? করার অনেক কিছুই আছে। শুধু মন-মানসিকতার ব্যাপার।
পবিত্র কোরআনের হাফেজরা মহান আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে তেমন মূল্যায়িত হচ্ছে না। কেবল রমজানে মানুষের মধ্যে হাফেজদের কদর থাকে। রমজানের পর তাদের খবর নিতেও কাউকে দেখা যায় না। আমাদের দেশে হাফেজরা রাষ্ট্রীয় কোনো মর্যাদা পান না। ‘সত্যিই বিষয়টি দুঃখজনক। হাফেজরা আল্লাহর কাছে সম্মানিত, তা আছে। তবে অন্যান্য মুসলিম দেশে হাফেজদের বিশেষ মূল্যায়ন করা হয়। তাদের সার্টিফিকেট এবং সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা আমাদের দেশেও হওয়া দরকার। প্রতি বছর যেভাবে হাফেজ তৈরি হচ্ছে, সে হারে মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে না। এতে হাফেজদের তারাবির জন্য মসজিদও মিলছে না। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কতজন হাফেজ আছেন, সে বিষয় সরকার কিংবা কোনো বেসরকারি সংস্থার কাছে পরিসংখ্যান নেই। যেহেতু মুসলমানের ধর্মীয় মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন শরিফ। আর সেই পবিত্র কোরআন শরিফ যাদের কলবের ভেতরে তাদের সেভাবেই মূল্যায়ন করা উচিত; বর্তমানে দেশে বিভিন্ন সেক্টরের পরিসংখ্যান রয়েছে, প্রতি বছর তা করছে। প্রতি বছর কমবেশি হাফেজ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু হাফেজদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, খুব দ্রুত হাফেজদের জন্য আলাদা একটি বিভাগ, সরকারি স্বীকৃতি হিসেবে তাদের জন্য সনদের ব্যবস্থা করা এবং প্রতি বছর হাফেজদের পরিসংখ্যান করে তাদের দফতরে সংরক্ষণ করা।
বর্তমান সরকার এর আগে কওমি মাদ্রাসার সনদের বিষয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে হাফেজদের নিয়ে সরকারিভাবে কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকায় আজ তারা সমাজে অবহেলিত, শুধু মসজিদের ইমাম অথবা মুয়াজ্জিনের মতো ধর্মীয় কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোরআনে কারিমের এত বড় খেদমতের সুযোগ যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হতো তাহলে সমাজ জীবনে হাফেজদের মূল্যায়ন করা হতো। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘হাফেজ’ কোটা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। হাফেজদের জন্য আলাদা একটি বিভাগ বা বোর্ড সৃষ্টি করা দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সব সেক্টরে নিয়োগের ক্ষেত্রে হাফেজদের জন্য আলাদা বোর্ড বা বিভাগ থেকে সনদপ্রাপ্ত হয়ে নিয়োগে সুযোগ দেওয়া দরকার। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাফেজ কোটা তৈরি করা যেতে পারে। হাফেজদের জন্য বর্তমান সরকারের সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা করা উচিত, যাতে হাফেজদের একটি শেষ ঠিকানা হয়। এ সরকার একটি সুন্দর হাফেজ নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেÑএটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখক : হাফেজ ও সাংবাদিক
"