নিতাই চন্দ্র রায়

  ২২ মে, ২০১৮

বিশ্লেষণ

স্বশাসিত গণতান্ত্রিক জেলা সরকার

একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য স্বশাসিত ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের বিকল্প নেই। জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ ছাড়া যে দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, শিল্প, পরিবেশ সংরক্ষণসহ কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব নয়, এটা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ একবাক্যে স্বীকার করেন।

এ বিষয়ে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদের ৫৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার দেওয়া হবে। আরো উল্লেখ আছে, এই সংবিধানের ও অন্য কোনো আইন-সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করিবেন, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লিখিত অনুরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন। এ ছাড়া এই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের বিধানাবলিকে পূর্ণ কার্যকরতাদানের উদ্দেশ্যে সংসদ আইনের দ্বারা উক্ত অনুচ্ছেদে উল্লিখিত স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করিবার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ ও নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা প্রদান করিবেন।

সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরে ড. এ কে আবদুল মোমেন রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘বর্তমানে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের বেশি। তবে এটাকে ১০ শতাংশে উন্নতি করতে জেলায় জেলায় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে এটি উল্লেখ থাকবে।’ তার মতে, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০২৩ সালের মধ্যে জেলায় জেলায় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর মানে এই নয়, কেন্দ্রীয় সরকার থাকবে না। কেন্দ্রীয় সরকারও থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সব উন্নয়ন কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করবে। জেলা সরকার গঠন হলে এলাকার চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সুবিধা হবে। জনসেবার মান বাড়বে। প্রতিটি মানুষ যেন জেলায় সব ধরনের সেবা পায় সে জন্যই এটা করা হবে। ২০২৪ সালের মধ্যেই দেশে আর দারিদ্র্য থাকবে না। তবে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধীরা, যা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ সরকারের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। সরকার তাদের দেখাশোনা করবে। এ ছাড়া তিনি ২০০৩ সালে ‘জেলায় জেলায় সরকার’ নামে একটি বই প্রকাশ করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একাধিকবার ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য অনুরূপ ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সব উন্নয়ন কর্মকা-ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনিক কাউন্সিল ও জেলা গভর্নর পদ্ধতি প্রবর্তন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ওই পদ্ধতিতে খাদ্য, শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, কৃষি, সেচ, পরিবার পরিকল্পনা ও আইনশৃঙ্খলাসহ জেলার সব কর্মকা- জেলা গভর্নরের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল জেলা প্রশাসনিক ইউনিটের সরাসরি কেন্ত্রীয় সরকারের অধীনে কাজ করার।

২০১৬ সালের আগে স্থানীয় সরকারের অন্যতম স্তর জেলা পরিষদে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সংবিধান ও আইন বিধিবিধানে স্থানীয় সরকারের সব স্তর জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হওয়ার বিধান থাকলেও এসব বিধিবিধান এ ক্ষেত্রে অকার্যকর ছিল দীর্ঘকাল। স্বাধীনতার পর প্রথম ১৯৮৮ সালে জেলা পরিষদগুলোয় সংসদ সদস্যদের চেয়ারম্যান হিসেবে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকার শাসনের অবসান হলে ১৯৯১ সালে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের নিয়োগ বাতিল করা হয়। সে সময় থেকে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছিল জেলা পরিষদ। সমতলের ৬১টি জেলা পরিষদে ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জনগণের প্রতিনিধিদের পরোক্ষ ভোটে জেলা পরিষদ গঠিত হলেও তার কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মকা- এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না জনগণের কাছে। জেলার প্রায় সব কর্মকা-ই ব্রিটিশ আমলের মতো কেন্দ্রীয় সরকারের আমলাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, যেখানে জনগণের মতামত প্রদান বা অংশগ্রহণের কোনো সুযোগই নেই বললেই চলে।

দেশের সর্বমহল থেকে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন, স্বশাসন ও গণতন্ত্রায়ণের কথা বারবার উচ্চারিত হলেও এ পর্যন্ত সেন্টার ফর ডেমোক্র্যাটিক লোকাল গভার্নেন্স (সিডিএলজি) ছাড়া কোনো মহল থেকেই গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়নি। ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারি, সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার গবেষক আবু তালেব গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখাটি ঢাকার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘স্বশাসিত স্থানীয় সরকার : গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত’ শীর্ষক এক জাতীয় সেমিনারে তৎকালীন সরকারের গঠিত ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ ও অন্যান্য সবার অবগতি ও বিবেচনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেন। ওই রূপরেখায় নগর সরকার, নগরীয় কৃষি এবং পরিকল্পিত নগরায়ণ ও সুবজায়নের কথাও বলা আছে।

বাংলাদেশে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে সর্বনি¤œ এবং জেলাকে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে নির্ধারণ করা উচিত। জেলা এক হাতে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারগুলো ও অন্য হাতে নগরীয় স্থানীয় সরকারগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে এবং জেলা সরকারের কাজ হবে প্রদেশিক সরকারের মতো। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারের প্রত্যেকটি ইউনিটের সঙ্গে সরকার শব্দটি যুক্ত করে সেগুলোকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। যেমন ইউনিয়নে ইউনিয়ন সরকার, উপজেলায় উপজেলা সরকার, জেলায় জেলা সরকার এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে একরূপ নগর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জেলা বিধানিক বিভাগ (জেলা সংসদ), জেলা নির্বাহিক বিভাগ ও জেলা বিচারিক বিভাগের সমন্বয়নে স্বশাসিত ও গণতান্ত্রিক জেলা সরকার গঠন করতে হবে। জেলা সরকারের মেয়াদ হবে চার বছর। জেলা সংসদ হবে জেলার সব কর্মকা-ের গণতান্ত্রিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রবিন্দু। জেলা সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ জেলা নির্বাহী বিভাগ বাস্তবায়ন করবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলাকে কতগুলো নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করতে হবে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী সদস্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং তাদের সমন্বয়েই জেলা সংসদ গঠিত হবে। জেলা সংসদের সভাপতি জেলা সংসদ সদস্যদের ভোটে তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। জেলা চেয়ারম্যান ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। তিনি বিচারিক ও নির্বাচনিক দায়িত্ব ছাড়া আর সব দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি একাধারে জেলার, জেলা সরকারের ও জেলা নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন। মিলেনিয়াম প্রোপোজাল পার্ট ওয়ানের আলোকে প্রতিটি জেলায় একজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও একজন পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচন করতে হবে। জেলা বিচারিক বিভাগ প্রশাসনিক ও বিধানিক বিভাগ থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা থাকবে। এসব ছাড়াও প্রতিটি জেলায় একজন জেলা ন্যায়পাল থাকবেন। তিনি নির্বাচিত ও অনির্বাচিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ/অনুযোগ তদন্ত সাপেক্ষে মীমাংসা/নিষ্পত্তি করবেন। তিনি ভোটারদের সরাসরি ভোটে কিংবা জেলা সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। জেলা সরকার গঠনে সিডিএজির প্রস্তাব যে হুবহু বাস্তবায়ন করতে হবে, তা নয়। প্রয়োজনে দেশের স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ও বিশিষ্টজনদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা সরকারের রূপরেখাটি পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের মতো ১৬ কোটি মানুষের একটি সমস্যা-সংকুল দেশ এ ধরনের এককেন্দ্রিক দূরবর্তী সরকার ব্যবস্থার দ্বারা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। তাই অর্থ, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক বাণিজ্যের মতো কিছু বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে বাকি কাজগুলো জেলা সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়াই হবে যুক্তিযুক্ত। এতে সব উন্নয়ন কর্মকা-ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ জনগণের জীবনযাত্রার অভাবিত উন্নতি হবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করাও সম্ভব হবে।

লেখক : কৃষিবিদ ও স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist