ইয়াসমীন রীমা

  ২১ মে, ২০১৮

বায়ুদূষণ

শিশুস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি

রঙ্গনের বয়স আট বছর, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কয়েকদিন ধরে সে অসুস্থ। বাবা ডাক্তার দেখিয়েছেন কিন্তু সুস্থ হচ্ছে না রঙ্গন। সর্দি, শ্বাসকষ্ট লেগেই আছে। কিছুদিন আগে একবার পেটের পীড়ায় অনেক ভুগতে হয়েছে তাকে। শরীর দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। খাবার-দাবারসহ খেলাধুলার প্রতিও রয়েছে অনীহা। লেখাপড়ায় মনোযোগ হারাচ্ছে রঙ্গন। স্কুলে নির্জীব হয়ে বসে থাকে। রঙ্গনের মা রিনি আক্তার ছেলের এমন স্বাস্থ্যহানি নিয়ে খুবই চিন্তিত। এ অবস্থায় তিনি ছেলেকে নিয়ে শিশু ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, রঙ্গন বায়ুদূষণজনিত ভাইরাসে আক্রান্ত।

রঙ্গনের মতো বহু শিশু বায়ুদূষণের ফলে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বায়ুদূষণের মাত্রা। যার প্রভাব পড়ছে মানবস্বাস্থ্যে, বিশেষ করে শিশুদের ওপর। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এবং পরিবেশদূষণের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এসবের বেশির ভাগই মানবসৃষ্ট। শীতকালে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। শীতকালে বায়ুম-লে মিশে থাকা দূষণকারী পদার্থ ওপরে উঠতে পারে না। বায়ুম-লের একটি নির্দিষ্ট স্তরে অবস্থান করে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে। ফলে দূষণের মাত্রা অনেক গুণ বেড়ে যায়। বিশেষষ্ণদের মতে, এ সময় মূলত ক্ষতিকর রাসায়নিক গ্যাস বা পদার্থ বায়ুতে মিশে জীবজগতের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরোকার্বন বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক। তাই শ্বাসজনিত রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায় এ সময়। শিশুরা এর শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে দেশে বায়ুদূষণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশে বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস ইটভাটা, যানবাহনের জীবাশ্ম জ্বালানি দহন ও শিল্প-কারখানার দূষিত ধোঁয়া, স্টিল ও রি-রোলিং, সিরামিকস, প্লাস্টিক কারখানা ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ শহর বায়ুদূষণে আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বায়ুদূষণকে অদৃশ্য ঘাতক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বায়ুদূষণের প্রভাবটি খোলা চোখে দেখা না গেলেও এটা মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। উদ্বেগের বিষয় হলো, বিশ্বের ৮০ ভাগের বেশি শহরের বায়ু অনিরাপদ। জাতিসংঘের এক জরিপে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে বিশ্বজুড়ে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ হেক্টর বনভূমি। সে হিসেবে প্রতি মিনিটে ধ্বংস হচ্ছে প্রায় আট হেক্টর বনভূমি। বাংলাদেশে গড়ে ২৪ ঘণ্টায় ১ লাখ ৩০ হাজার গাছ কাটা হচ্ছে, যার বিপরীতে রোপণ করা হচ্ছে মাত্র ৩০ হাজার চারাগাছ। এসব পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে কী নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর।

জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সহযোগিতায় ‘ক্লিয়ার দ্য এয়ার ফর চিলড্রেন’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি বছর বায়ুদূষণের কারণে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী ছয় লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটে। বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু এমন এলাকায় বাস করে সেখানে বায়ু অত্যাধিক দূষিত। এর মধ্যে ২২ কোটি শিশু দক্ষিণ এশিয়ার। প্রতি সাতজন শিশুর মধ্যে একজন শিশুর বাড়ির আঙ্গিনা দূষিত। বেসরকারি সংস্থা ‘সুস্থ শিশু, সুস্থ জীবন’-এর এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটির অধিক শিশু বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১২ ভাগ শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত।

পৃথিবীর প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ শহরে বাস করে এবং উন্নত দেশের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৯০ ভাগ পর্যন্ত। এই বিশালসংখ্যক মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যায় শহরের বায়ুতে। উন্মুক্ত স্থান, কৃষিভূমিতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা, রাস্তাঘাট, ভূগর্ভস্থ নর্দমা ও শিল্প-কলকারখানা নির্মাণের ফলে শহরগুলোয় বায়ুদূষণ সৃষ্টি হয়। দূষিত বায়ু বা অস্বাস্থ্যকর বায়ু বলতে বায়ুতে যদি মাত্রাতিরিক্ত কার্বন মনো-অক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড, পার্টিকুলার ম্যাটার ও সালফার ডাই-অক্সাইড থাকে তাকে দূষিত বায়ু বা বায়ুদূষণ বলা হয়। সারা পৃথিবীতে ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) সূচকে বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ধারণ করা হয় ০ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার উত্তম বায়ু, ৬ থেকে ৫০ মাইক্রোমিটার মধ্যম, ৫১ থেকে ১০০ মাইক্রোমিটার দূষিত, ১০১ থেকে ২০০ মাইক্রোমিটার অস্বাস্থ্যকর এবং ২০১ থেকে ৩০০ মাইক্রোমিটার খুব অস্বাস্থ্যকর বায়ু হিসেবে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি আরবান ল্যাবের হিসাব মতে, প্রতি মাইক্রোগ্রাম বাতাসে ১-১২ মাইক্রোমিটার বস্তুকণা থাকার কথা। রাজাধানী ঢাকাতে এর মাত্রা ১৮৪ থেকে ২২৫ মাইক্রোমিটার। দুটি প্রক্রিয়ায় সাধারণত বায়ু দূষিত হয়ে থাকে। প্রথমত, প্রাকৃতিক উপায়ে ও দুই, কৃত্রিম উপায়ে। প্রাকৃতিক উপায়ে বায়ু দূষিত হয় সাধারণত আগ্নেয়গিরি, দাবানল, ধূলিঝড়, ইত্যাদির মাধ্যমে। কৃত্রিম উপায় হলো মানুষের সৃষ্টি চলমান যন্ত্রের দ্বারা বায়ুদূষণ, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার মাধ্যমে বায়ুদূষণ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মতিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ হাঁপানি রোগী রয়েছে, যাদের ৭৫ ভাগ শিশু। প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার শিশু রোগীর অকালমৃত্যু ঘটে শহরগুলোয়। শুকনো মৌসুমে বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যাধিক বৃদ্ধি হওয়ায় এ সময় শিশুদের হাঁচি, কাশি ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেড়ে যায়। বায়ূদূষণে শুধু শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষতি করে তা নয়, এটি মস্তিষ্ককে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং হজম প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। রোগ-জীবাণুমিশ্রিত ধুলাবালু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুস ক্যানসার, শ্বাসজনিত কষ্ট, হাঁপানি, যক্ষ্মাসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করছে। যেসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

কেবল কলকারখানা বা যানবাহনের কালো ধোঁয়াই নয়, ঘরের ভেতরে বায়ুদূষণের কারণে নানা ধরনের রোগে ভুগে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮ হাজার ৫০০ শিশু মারা যায়। ঘরে রান্নার জন্য লাকড়ি, কৃষিবর্জ্য, গোবরের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোয় বায়ুদূষণ হয়। গ্রামাঞ্চলে ৮৯ ভাগ রান্নায় এখনো লাকড়ি, গোবর পোড়ানো হয়। যার ফলে শিশুরা শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। দরিদ্র ও অসহায় পরিবারের শিশুরাই এতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। সচেতনার অভাবেও শিশুরা দূষিত ধোঁয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। একটু সচেতন হলে রান্নার কাজে সাধারণ চুলার পরিবর্তে বন্ধুচুলা ব্যবহার করলে এ দূষণ অনেকাংশে রোধ করা যায়।

পরিবেশবিদদের মতে, বায়ুদূষণ অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এর কারণে শিশুস্বাস্থ্য ও শিশুর বেড়ে ওঠা ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক তিনটি দিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প-কলকারখানা, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, ইটভাটা ও মুঠোফোনের টাওয়ার ইত্যাদি নিয়মনীতি না মেনেই যেখানে-সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে এসব।

বায়ুদূষণ শুধু আমাদের দেশেই নয় পৃথিবীর বহু দেশের জন্যই উদ্বেগজনক। ইটভাটাসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ধোঁয়া যাতে বায়ুদূষণের কারণ না হয়, সেই দিকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ঢাকা ও এর আশপাশের ইটভাটাগুলো উন্নত প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। পুরোনো গাড়ি যেগুলো কালো ধোঁয়া ছড়ায়, সেগুলো রাস্তায় চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার বাড়ালে বায়ুদূষণের হাত থেকে নারী, শিশুসহ সাধারণ মানুষ মুক্তি পাবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সবার ভূমিকা রয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist