এস এম মুকুল

  ১৯ মে, ২০১৮

হস্তশিল্প

সুচের ফোঁড়ে আসছে ডলার

বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের গৌরবগাথা ইতিহাস। চেতনায়, জাগরণে, একতায় আর মুক্তির সংগ্রামে অকুতোভয় বীর বাঙালির কথা বিশ্ববাসী জেনেছে বহুবার। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে জাগ্রত বাঙালির অধিকার আদায়ে সংগ্রামের স্রোতধারা ৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে শেষ হয়। সংগ্রামে-সাফল্য বাঙালির বীরত্বের প্রমাণস্বরূপ। বিশ্ব বিশ্লেষণে আমাদের সুনাম আছে। দেশটা নিয়ে গর্ব অনেক। স্বপ্ন অনেক। আমরা যে যেই পেশাতে নিয়োজিত আছি, সেখান থেকেই যদি সবাই দেশকে ভালোবাসি, তবেই সে ভালোবাসা মর্যাদা পাবে। স্বাধীন দেশ। সমস্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অনেক অগ্রসর হয়েছে। পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবেÑএমন বিশ্বাসও জন্মেছে মানুষের মনে। দেশের মানুষের চোখ-কান খুলে গেছে। মানুষকে এখন ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর সুযোগ কম। বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে মন ভোলানোর দিন শেষ। মানুষ এখন সব জেনে গেছে, সব বুঝেছে। দেশের মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে সচেতনতা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক তৎপরতাও সৃষ্টি হচ্ছে। সবাই ভালো থাকতে চায়। সচ্ছল থাকতে চায়। নিরাপদ কাজের এবং জীবনযাপনের পরিবেশ চায়।

না। কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। আমরাও পারি গৌরবময় অর্জন ছিনিতে আনতে। আমাদের নারীরা, অবলা নয়। নারী জাগরণের নতুনমাত্রা এসেছে। অর্থনীতির মূলস্রোতে আসছেন আমাদের নারীরা। নারীরা প্রমাণ করছেন সব কাজে, নিষ্ঠায়, সততায়, মেধায়, সাফল্যে, সমহিমায় তারা পুরুষের চেয়ে কম নয়। নারীদের সফলতার খবর আছে বহু ধরনের। যুগে যুগে বাংলাদেশের নারীরা সব কাজের পাশাপাশি অবসরে মায়াবী হাতের সুনিপুণতায় চিত্রিত করেছেন মা, মাটি, মানুষ আর ভালোবাসার প্রতিকৃতি। দৃষ্টির আড়ালে থাকা এই বিশাল সম্ভাবনাময় শিল্পকে জাগিয়ে তুলেছেন নারীরা। তাদের সুনিপুণ হাতের কাজ বিশ্বকে করেছে জয়। সময়টা ১৯৮৫। যশোরের শার্শা উপজেলায় ১৬ জন মহিলা নিয়ে জাপান-বাংলাদেশ কালচারাল এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন (জেবিসিইএ) যাত্রা শুরু করে নকশিকাঁথা প্রকল্পের। ১৯৯৭ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় প্রকল্পটি। ধীরে ধীরে এগোতে থাকে গ্রাম-বাংলার নারীদের স্বপ্নগাথা নকশিকাঁথার গল্প। ক্রমেই নকশিকাঁথা হয়ে বাংলার গর্বগাথা। বর্তমানে শার্শার নিশ্চিন্তপুর, পশ্চিম কোটা গ্রামসহ প্রায় ১০টি গ্রামের চার শ গৃহবধূ এবং স্কুল-কলেজপড়–য়া ছাত্রীরা পড়াশোনা আর গৃহকর্মের পাশাপাশি তৈরি করছেন চিরায়ত বাংলার গর্বগাথা নকশিকাঁথা। এসব কাঁথা চলে যাচ্ছে জাপানের টোকিও শহরে। সেখানে রয়েছে রসুন নামে একটি বিক্রয়কেন্দ্র। সেখান থেকে বিভিন্ন দেশের মানুষ এই আকর্ষণীয় নকশিকাঁথা কিনে নেয় উচ্চমূল্যে। নাভারনের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে ১৫০ জন মহিলার নকশিকাঁথা কার্যক্রম দেখাশোনা করেন দলের সভানেত্রী তাসলিমা বেগম। তাসলিমা লাউ ডিজাইনের ওপর হাতের কাজ করে সুনাম অর্জন করেন। নকশিকাঁথা প্রকল্পের নামডাক এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গেছে। বাংলার নকশিকাঁথা নিয়ে এসেছে জাপানি অ্যাওয়ার্ড। এই নকশিকাঁথা প্রকল্পের পরিচালক জাপানি মিসেস মিয়াকো মাগামি। প্রকল্পের সভানেত্রীর কাছে অ্যাওয়ার্ড তুলে দিয়েছেন মাগামি। এ ছাড়া ২০০৫ সালে ৩০ মার্চ জাপানের নাকানো সিটির বস্ত্রমেলায় ৭০টি স্টলের মধ্যে বাংলাদেশি গৃহবধূ ফুলসুরাত বেগমের লাউ ডিজাইন চাদর অ্যাওয়ার্ড পায়। তারপর থেকে জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে আসে নকশিকাঁথার ডিজাইন কৌশল স্বচক্ষে দেখতে। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের নকশি ডিজাইনার গৃহবধূদের নিয়ে যাওয়া হয় জাপানে। সে দেশের লোকদের তারা দেখিয়ে দিয়ে আসে বাঙালির হাতের নৈপুণ্য। জাপান আর বাংলাদেশ একাকার হয়ে গেছে ভাতৃত্বে, সৌহার্দ্যরে পরম মমতায়।

শার্শার নকশিকাঁথা এখন রফতানি হচ্ছে। স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক গৃহবধূ। সচ্ছলতা আসছে অনেক টানাপড়েনের সংসারে। বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। খুলছে সম্ভাবনার দুয়ার। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের নারীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে তাদের সুনিপুণ হাতে দক্ষতার সঙ্গে কাপড়ে কাপড়ে চিত্রিত করে গ্রাম-বাংলার অনন্য চিত্রকর্ম। চাহিদানুযায়ী নিত্যনতুন আকর্ষণীয় ডিজাইনের দস্তরখান, বেড কাভার, হাত ব্যাগ, ওয়ালম্যাট ও টেবিল ক্লথ থেকে শুরু করে সুচ ও সুতা দিয়ে তৈরি অনেক জিনিস। গ্রামীণ নারীদের চোখ জুড়ানো আলপনায় রয়েছে শিল্পকর্ম। নকশিকাঁথা ভিন্ন সৌন্দর্যের। এমন আরেকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যশোরে। যশোর স্টিচের নামটি এখন দেশ-বিদেশে খুবই পরিচিত। দুস্থ, অভাবী ও অসহায় মহিলারা নকশিকাঁথা ও সূচিশিল্পে জড়িত হয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মহিলাদের সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে আসছে ডলার।

গ্রাম-বাংলায় কাঁথা সেলাইয়ের ঐতিহ্য বহুকাল আগের। পুরোনো শাড়ি ও লুঙ্গি মাটিতে বিছিয়ে চারদিকে খেজুরের কাঁটা দিয়ে বাড়ির মহিলারা অবসর সময়ে নিজেদের প্রয়োজনে কাঁথা সেলাই করেন। নতুন কাঁথা বিছিয়ে অতিথিকে বসতে দেওয়ার রেওয়াজ গ্রামে গ্রামে রয়েছে এখনো। গ্রামে বেকার, অভাবী, দুস্থ ও অসহায় মহিলারা সূচিশিল্পের জন্ম দেয়। কাঁথা তৈরি ও বিক্রি শুরু হয়। সেই ইতিহাস অনেক পুরোনো কথা। তারই ধারাবাহিকতায় যশোরে নকশিকাঁথা ও সূচিশিল্প গড়ে ওঠে। যার নামকরণ হয় ‘যশোর স্টিচ’। যশোর থেকে সূচিশিল্প পণ্য রফতানি হচ্ছে নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশে। আসছে ডলার। সূচিশিল্পের সঙ্গে জড়িত অভাবী, দুস্থ ও অসহায় মহিলাদের অস্থির ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর নেই। অন্ধকার ও দুশ্চিন্তা কেটে গেছে। শহরতলি খোলাডাঙা থেকে শুরু হলেও, এখন গ্রামে গ্রামে সূচিশিল্প বিস্তৃত। এর পৃষ্ঠপোষকতা করছে স্যালভেশন আর্মি। তাদের মাধ্যমেই ওসব পণ্য বিদেশে রফতানি হয় নিয়মিত। ঢাকার বনানীতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে রয়েছে তাদের শোরুম। নিজস্ব তাঁতের কাপড় ও সুচ-সুতা তারা সরবরাহ করে। মহিলারা পায় প্রতিটি ফোঁড়ে টাকা। বিদেশে টেবিল ক্লথ, কুশন কভার, ওয়ালম্যাট, এডভেন্ট ক্যালেন্ডার, বেড কভার, চশমা কভার, দস্তরখান, হাত ব্যাগসহ সূচিশিল্পের বিভিন্ন জিনিসের চাহিদা এতটাই বেড়েছে, সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। যশোরের গ্রাম সীতারামপুর, ফতেপুর, ঘুরুলিয়া, কনেজপুর, ডাকাতিয়া, বড় শেখহাটি, বালিয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন গ্রামের সহস্রাধিক মহিলা বিদেশে রফতানিযোগ্য সূচিশিল্প পণ্য তৈরি করছেন। সংসারের কাজকর্ম যথারীতি করার পরও বাড়তি অর্থ প্রতিটি পরিবারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়েছে। স্বাবলম্বী হওয়ায় তাদের চোখে-মুখে এখন আশার ঝিলিক। সন্তানাদি মানুষ করার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

নকশিকাঁথা সূচিশিল্পের আরেক সাফল্য। বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে যশোরের নকশিকাঁথা। যশোর শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরার পান্থাপাড়া। যশোর-মাগুরা সড়কের গা-ঘেঁষা গ্রামটিতে কয়েক শ মহিলা নকশিকাঁথা সেলাইয়ের কাজ করেন। প্রথম দিকে একটি এনজিও কয়েকজন মহিলাকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। তারপর ধীরে ধীরে এলাকার দুস্থ, অভাবী ও অসহায় মহিলারা নকশিকাঁথা শিল্পে জড়িত হয়ে পড়েন। একটি কাঁথা সেলাই করতে একজন মহিলার সময় লাগে ১৫-১৬ দিন। কয়েকজন মিলে করলে তা ২-১ দিনেই হয়ে যায়। ঘন ডিজাইনের নকশিকাঁথা সেলাইয়ের জন্য একজন মহিলা ১ হাজার ৮০০ টাকা পাচ্ছেন। কাপড়, সুতা, সেলাইসহ একটি নকশিকাঁথা তৈরি করতে খরচ হয় ৩ হাজার টাকা। বিদেশে ওই নকশিকাঁথা বিক্রি হয় সর্বনিম্ন সাত হাজার টাকা। ঘন ও ভালো ডিজাইনের নকশিকাঁথা বিদেশের বাজারে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে যশোরসহ যেসব অঞ্চলের মহিলারা নকশিকাঁথা সেলাই করতে পারেন, তাদের সংগঠিত করে এ শিল্প গড়ে তোলা গেলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এর অবদান অন্য কারো চেয়ে কম হবে না বলেই অনেকের ধারণা। নকশিকাঁথার আরেক এলাকা ময়মনসিংহের জামালপুর। জামালপুর শহরে নকশিকাঁথার অনেক শোরুম আছে। ঢাকায় যে বাহারি নকশিকাঁথা পাওয়া যায়, তার বেশির ভাগ তৈরি হয় জামালপুরে। নকশিকাঁথা ও সূচিশিল্পে জামালপুরে নীরব বিপ্লব ঘটছে। জামালপুরের চোখ জুড়ানো নকশিকাঁথা শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও সুনাম কুড়াচ্ছে। কর্মদক্ষ মহিলা উদ্যোক্তারা জামালপুরে গড়ে তুলেছেন শতাধিক ছোট-বড় সূচিশিল্প প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া রয়েছে ব্র্যাক পরিচালিত আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন। এ প্রতিষ্ঠানে ২০ হাজারের বেশি গ্রামীণ দরিদ্র মহিলা কাজ করছেন। তৈরি করছে বেড কাভার, বটুয়া, হ্যান্ডপার্স, কয়েন পার্স, ভ্যানিটি ব্যাগসহ নানা দ্রব্য। ছয় হাত দৈর্ঘ্য এবং পাঁচ হাত প্রস্থ একটি নকশিকাঁথা তৈরি করতে কাপড় লাগে ১২ গজ। সাদা কাঁথার জন্য মার্কিন অব হোয়াইট এবং রঙিন কাঁথার জন্য থাই কটন ব্যবহার করা হয়। একটি কাঁথায় শ্রমজীবী মহিলা পান সাড়ে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা। জামালপুরের নকশিকাঁথার শোরুম রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো দেশের বড় বড় শহরেও। আর এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে সূচিশিল্পের স্বপ্নযাত্রা।

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist