রহিম আবদুর রহিম

  ০১ মে, ২০১৮

মতামত

কোটা আন্দোলনের পক্ষ-বিপক্ষ

৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সুফল জাতি ভোগ করছে। ৭ মার্চের ব্রজকণ্ঠে উজ্জীবিত জাতির একটি অংশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমরযুদ্ধে লাখো প্রাণ শহীদ হয়েছেন। সন্তান হারা বাা-মা, স্বামী হারা স্ত্রী, বাবা-মা হারা লাখো মানুষের শান্তি একটাই; দেশ আজ স্বাধীন। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের যেমন বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে যৌক্তিক চাওয়া-পাওয়ার অধিকার। স্বাধীন দেশের জনগণ তার সরকারের কাছে যৌক্তিক যেকোনো দাবি পেশ করতেই পারে। কোনো যৌক্তিক দাবি আন্দোলনের বিষয়টিকে অন্ধভাবে ষড়যন্ত্র বলা ঠিক নয়। আবার আন্দোলনকে যদি পুঁজি করে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, তাদের নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য কোনো ফাঁদ পাতার চেষ্টা করে, তবে ওই গোষ্ঠী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদেরই অবস্থান নেওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে শিখিয়েছেন, যেকোনো অন্যায়-বৈষম্যের বিরুদ্ধেই আমাদের আন্দোলন। তিনিই উদ্বুদ্ধ করেছেন যৌক্তিক দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফেরা নয়। তারই অনুপ্রেরণায় আজ আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের নাগরিক।

স্বাধীন দেশে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার মূলমন্ত্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতধারায় শামিল করা। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের যে কোটা রাখা হয়েছে, তা পুরোপুরি কৃতজ্ঞতা স্বীকার এবং মহান মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মকে কৃতজ্ঞতার ইতিহাসে সম্পৃক্ত করা। পৃথিবীর কোনো দেশেরই মুক্তিকামী সৈনিক বা মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দেশের সরকার বিন্দুমাত্র সুযোগ-সুবিধা দেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একমাত্র বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত সরকারই মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটার প্রচলন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার পর চাকরির ক্ষেত্রে যে বয়স প্রয়োজন, ওই বয়সের মুক্তিযোদ্ধা যেমন পাওয়া মুশকিল, তেমনি সব ক্ষেত্রেই শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধা মেলানো দুষ্কর। যার কারণে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০০ টাকা সম্মানী ভাতা এবং চাকরি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটা পদ্ধতি চালু করেন। ৩০০ টাকার ভাতা বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাটাগরি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ১০ হাজার পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এ সরকারের এই সম্মানবোধ শুধু প্রশংসার দাবি রাখে না, যা চিরস্মরণীয়ও বটে। সরকারের চালু করা কোটা পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা, ১০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠী ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ। সব মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ চাকরি কোটার আওতায় পড়েছে। বাকি ৪৪ শতাংশ চাকরি পাচ্ছে সাধারণ মেধা কোটায়। কোটা পদ্ধতিতে চাকরির বিষয়টি শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে। কারণ, বৈষম্য দূর করা, পিছিয়ে পড়াদের মূলধারায় তুলে আনা। তবে বৈষম্য দূর করতে গিয়ে যেন আবার বৈষম্য সৃষ্টি না হয় সেটাও সময়ের ব্যবধানে দায়িত্বশীলদের ভাবতে হবে। বিভিন্ন কোটায় যদি ৫৬ শতাংশ হয়, তবে সাধারণ মেধায় ৪৪ শতাংশ, এখানেও একটা বৈষম্য বিরাজ করছে। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনটি ব্যাপক জনপ্রিয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এ আন্দোলনকে ঘিরে কাদা ছোড়াছুড়ি, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ, রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টাও কম হচ্ছে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনে এ যাবৎ যা কিছু ঘটেছে, তার কোনোটাই শুভ নয়। সবকিছুর মধ্যেই ফারাক, অপরাধ, রাজনৈতিক চাতুরতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বশীলদের অতি-উৎসাহী কর্মকা-, আবেগ এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে।

আন্দোলনকারীরা চেয়েছিল কোটার সংস্কার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে অভিমান করে বলেছেন, ‘কোটা সংস্কার করে লাভ কী, আবারও আন্দোলন হবে, তার চেয়ে কোটার দরকার নেই। তিনি পরক্ষণেই বলেছেন, পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠী কিংবা বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য প্রয়োজনে কোটা ছাড়া অন্য কীভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে চাকরি দেওয়া যায় সে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে, তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে যৌক্তিক মনে করেছেন তবে সংস্কারের নামে বারবার যেন আন্দোলন না হয়, এটা তিনি চেয়েছেন। তবে পিছিয়ে পড়ার গোষ্ঠীর জন্য বলবৎ রাখা শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, একেবারেই মানবিক। প্রধানমন্ত্রী আবেগ, ক্ষোভ প্রকাশ করার কারণ, আন্দোলনকারীদের কাছে সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধি পাঠানোর পরও আন্দোলনকারীরা তা শুনেনি, আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আন্দোলনকারীরা, কোটা সংস্কার বা বাতিল হোক, এ দাবিটিকে পেছনে রেখে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি তুলতে পারত, তবে আন্দোলনটি পরিপক্ব বলে মনে হতো। তা তারা করেননি, আনন্দে আত্মহারা আন্দোলনকারীরা পরদিন বিশাল সমাবেশ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘মাদার অব ইডুকেশন’ উপাধিতে ভূষিত করে সেøাগান দিয়েছেন। এ ধরনের কর্মকা-ে আন্দোলনকারীরা দেশবাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, তারা কেউ রাজাকার, শিবির, জামায়াত, বিএনপি, জাসদ, বাসদ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নন। একেবারেই সব দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে নতুন প্রজন্ম, তাদের সমষ্টিগত একটি দাবি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া উপাধির পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা হতেই পারে। উপাধির গুরুত্ব বর্তমানে নাও থাকতে পারে। শত বছর পরে এই উপাধি, শেখ হাসিনার কর্মময় জীবনের ইতিহাসে জায়গা করে নিবেই এতে কোনো সন্দেহ নেই।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে জামায়াত, বিএনপি কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন নয়, তবে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা জামায়াত, বিএনপি, জাসদ, বাসদ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শে বিশ্বাসী হতেই পারে। অর্থাৎ আন্দোলনটি সর্বদলীয় তারুণ্যের। কোটা বিলুপ্ত হোক এটা কেউ চায় না। তবে সংস্কার হোক, এটা সবারই কাম্য, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের জন্য যে কোটা রাখা হয়েছে, তার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। ধরুন, আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমার সন্তান মুক্তিযোদ্ধার কোটায় পড়েছে। আমার নাতি বিয়ে করেছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার বা পিস কমিটির এক নাতিকে, এখন আমার নাতি যদি মুক্তিযোদ্ধার কোটায় পড়ে থাকে, তবে রাজাকার বা পিস কমিটির ওই নাতি কোন কোটায় পড়বে? অর্থাৎ নাতি-পুতির কোটা চিরতরে বিলুপ্ত করা, যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হবে বলে অনেকেই মনে করছেন।

লেখক : সাংবাদিক, নাট্যকার ও শিক্ষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist