ইয়াসমীন রীমা

  ৩০ এপ্রিল, ২০১৮

বিশ্লেষণ

মজুরি ও নিরাপত্তার কথা

গ্রিক শব্দ গধরঁং থেকে ‘মে’র উৎপত্তি। শব্দটি দেবী গধরঁং-এর সঙ্গে সম্পর্কিত। দেবী মেইয়াকে গ্রিকরা প্রাচুর্য ও প্রবৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে মানত। মানার কারণ ছিল মে মাস হচ্ছে গ্রিকদের ফসলের মৌসুম। এ ফসলের ওপর তাদের জীবিকা নির্ভরশীল ছিল। তাই গ্রিকরা মের আগমনে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের বিশ্বাসে দেবী মেইয়াকে অভিবাদন জানাত পুষ্পমঞ্জুরি প্রদান করে।

যিশু খ্রিস্টের জন্মের অনেক বছর আগে ইউরোপবাসী ঋতুরাজ বসন্তকে অভিবাদন জানাতে প্রচলন করে মে দিবস। মে’কে তারা ফুলের মালা, তোড়া দিয়ে স্বাগত জানাত। আর একে অপরের দেহে ফুলের পাপড়ি ছুড়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করত। আবার বসন্তকে নবযৌবনের প্রতীক মনে করত। তারা মে দিবস পালন করত বৃক্ষের ছায়াতলে বন্য পরিবেশে বসে। ধারণা করা হয়, সম্ভবত তারাই ইউরোপে প্রথম মে দিবসের সূচনা করে। আবার কারো কারো মতে, মে দিবসের প্রথম সূচনা হয় মিসর বা ভারতবর্ষে। তবে, ১৮৮৬ সালের ১, ৩ ও ৪ মে আমেরিকার শিকাগোতে এক রক্তাক্ত ঘটনার পর ১৮৯০ থেকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তে সারা বিশ্বে প্রতি বছর মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। পাল্টে যায় অতীতের সাথে মে দিবস পালনের মর্মবাণী। ‘হে’ মার্কেটে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী ঘটনার মধ্য দিয়ে আদায় হয়েছিল শ্রমিক অর্থাৎ খেটে খাওয়া মানুষের আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি। সারা বিশ্বে দিবসটি শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিবস হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে। এ দিবসে অনিবার্যভাবে উঠে আসছে শ্রমিকের মজুরি ও নিরাপত্তার কথা। মজুরির একটি জাতীয় মানদ- নির্ধারণ এখন সময়ের দাবি। শুধু শ্রমিকদের জন্যই এ মানদ- নির্ধারণ জরুরি নয়। দারিদ্র্যবিমোচনসহ সরকারের অসংখ্য কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করছে মজুরির মানদ-ের ওপর। বর্তমানে দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি, যাদের আয়ের একমাত্র উৎস হচ্ছে মজুরি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ মজুরি সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমার নিচে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের সর্বনি¤œ মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল মাত্র ৬০০ টাকা (সর্বসাকুল্যে ৯৩০ টাকা) ১৯৯৪ সালে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে সেটা বর্তমানে ২৫০০ টাকা নির্ধারিত করা হয়েছে। বর্তমানসহ বিগত প্রায় সব সরকারই দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপের সুফল পাঁচ কোটি শ্রমিকের কাছে পৌঁছাবে কীভাবে? যেখানে সরকারের নির্ধারিত মজুরিই একজন মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতে বাধ্য করছে। একইভাবে শ্রমিকের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও আজ একটি জাতীয় ইস্যু। বিদ্যমান শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণের যা পরিমাণ তা মালিকরাও কম মনে করছেন। ফিনিকস ভবন ধসে পড়ার ঘটনায় আদালত যে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করেছিল, তা ক্ষতিপূরণ আইনের নির্ধারিত পরিমাণের কয়েক গুণ কম।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে শ্রম আইনের আওতায় রয়েছে ২০ শতাংশেরও কম শ্রমিক। মালিকের বৈরী মনোভাব, শ্রম আইনের দুর্বলতা, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দুর্বলতা ট্রেড ইউনিয়েনে দুর্বলতা, প্রভৃতি কারণে ওই ২০ ভাগ শ্রমিকও বিদ্যমান শ্রম আইনের সুরক্ষা পায় না। মজুরির বিনিময়ে কাজ করে এমন শ্রমিকের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত আছে। অনেকের ক্ষেত্রে এই নির্ধারণের বয়স ১১ বছর, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২৪ বছরও পার হয়ে গেছে। আবার এর চেয়েও নির্মম সত্য হলো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকের মজুরির কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণই নির্ধারিত নেই। মালিকরা সেখানে ইচ্ছামতো মজুরি প্রদান করে। লাখ লাখ নারী-পুরুষ নির্মাণ খাতে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিয়োজিত।

মূলত শিল্প ও কৃষি ছাড়াও এ দেশে বিভিন্ন পেশার মানুষ শ্রমনির্ভর। যেমনÑকুটিরশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক, গার্মেন্টশিল্পের অসংখ্য নারীসহ পুরুষ শ্রমিক, ফুটপাতের ক্ষুদ্র পুঁজির মূলত শ্রমনির্ভর দোকানদার, ফেরিওয়ালা, হকারÑতাদের শ্রম ক্ষেত্রগুলোয় বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান। ১৯১৬ সালে ‘ভার্সাই চুক্তি’ অনুযায়ী লীগ অব নেশন্সের সঙ্গে শ্রমিকদের মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা করবে এর নাম হচ্ছে, আইএলও বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’। পরে লীগ অব নেশন্স বিলুপ্ত হয়ে গেলেও আইএলওটিকে যায়। একটি বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠান আইএলও বা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাই সর্বপ্রথম ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়। প্রাথমিকভাবে ৪৫টি দেশ এর সদস্য ছিল। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ১৫৭ সংখ্যায় উন্নীত হয়েছে। ১৯৪৪ সালে (ফিলাডেফিয়া) সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নতুন করে বিশ্লেষণে এক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে তা বলবৎ আছে। অর্থাৎ শ্রমপণ্য নয়। প্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংগঠন তৈরির স্বাধীনতা অপরিহার্য। দরিদ্র যেখানেই থাকুক না কেন, তা ভবিষ্যৎ মানবের জন্য সর্বত্রই হুমকিস্বরূপ। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও সম্মান অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বর্ণ-ধর্মমত ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষেরই তার পার্থিব উন্নতি ও আত্মিক বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়ার অধিকার রাখে।

আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার সবচেয়ে পুরোনো ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে একটি হচ্ছে ত্রিপক্ষীয় (সরকার মালিক শ্রমিক) কমিটি। আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলন কর্তৃক সম্পাদিত ও গৃহীত বিভিন্ন চুক্তি ও সুপারিশ মূলত এরই ফলে আন্তর্জাতিক শ্রমমান নিরূপণ সম্ভব হয়েছে। ১৯১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৫৮টি চুক্তি সম্পাদিত ও ১৬৬টি সুপারিশ গৃহীত হয়েছে। কতিপয় মৌলিক মানবাধিকার যেমনÑ‘সমিতি গঠনের স্বাধীনতা। বাধ্যতামূলক শ্রম রদ করা। কর্মসংস্থানের বৈষম্য দূরীকরণ। শ্রমিক পরিচালনা। কল-কারখানায় জনসংযোগ কর্মধারা সংস্থাননীতি। কর্মস্থলের সার্বিক অবস্থা। সামাজিক নিরাপত্তা। কর্মরত অবস্থায় সার্বিক স্বাস্থ্য ও অন্যান্য নিরাপত্তা। নারীর কর্মসংস্থান। বিদেশে কর্মরত শ্রমিক। নৌশ্রমিক এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কর্মে নিয়োগসমেত অজ¯্র বিষয়ের আওতাভুক্ত।’ এসব চুক্তি ও সুপারিশ কার্যকরী কারা সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে সে জন্য প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রই নিজ নিজ দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সেগুলো পেশ করে। চুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে এসব চুক্তির প্রয়োগ যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় সে জন্য এক তদারক পদ্ধতিরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কারণ শ্রমসংস্থার ত্রিপক্ষীয় কমিটি কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজস্ব বিশেষজ্ঞ দ্বারা সরেজমিন মূল্যায়নের স্বার্থেই এমন পদ্ধতির প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত আইএলওর ৩৭টি কনভেশন অনুমোদন করেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর ৫০ ও ৬০ দশক ছিল শিল্প পুঁজিবাদের উন্নততর স্তর সাম্রাজ্যবাদী পর্যায়ে রূপান্তরিত হওয়ার সন্ধিক্ষণ। ইতিহাসের ওই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণেই মার্কস-এঞ্জেলস শ্রমিক শ্রেণির দর্শনকে পরিপূর্ণভাবে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ৪০ দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মার্কসবাদ ছিল গঠনাত্মক স্তরে। ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট ম্যানুফেস্টোর প্রকাশ এবং ১৮৪৮-৫০-এর ইউরোপীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদের চূড়ান্ত বিকাশের পর্যায় সূচিত হয়। ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তেই মার্কস উদ্ভাবন করেন শ্রমিক শ্রেণির নিজস্ব রাজনৈতিক অর্থনীতির সমগ্র ভিত্তিমূল ও কাঠামোটিকে। ওই সময়ে মার্কস-এঞ্জেলসের অসামান্য অবদান হলো বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শগত সংহতি এবং ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রয়োজনে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার ঘটনা। মার্কস-এঞ্জেলস প্রতিষ্ঠিত ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’ তথা ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়াকিং ম্যান্স অ্যাসোসিয়েশন’ ছিল এক অর্থে বিভিন্ন দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর বিশ্ব প্রতিষ্ঠান। আর ওই সংগঠনের গর্ভেই নিহিত ছিল দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির নিজস্ব দল গঠনের সম্ভাবনা। ১৮৬৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আন্তর্জাতিক জেনেভা কংগ্রেস আট ঘণ্টার কাজের দাবিকে সারা বিশ্বের শ্রমিকদের সাধারণ কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করেছিল। ২১ জুন ১৮৮৬ সালে বিচারক জোসেফই গ্যারির আদালতে বিচারের নামে হলো প্রহসন। নিরপরাধ সঙ্গীদের বিরুদ্ধে একটি সাজানো মামলা তৈরি হচ্ছে জেনে আলবার্ট পার্সনস ক্ষেপে উঠলেন। কোর্টে হাজির হলে তাকেও ফাঁসি দেওয়া হবে। তা সত্ত্বেও আদালত কক্ষে ঢুকেই বিচারকের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘হে মাননীয় বিচারক আমি এসেছি আমার নিরপরাধ কমরেডদের সঙ্গে বিচারের সম্মুখীন হতে।’ একজন বন্ধুকেও তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি কী করেছি। ওরা আমাকে খুন করবে। কিন্তু আমার মতোই সমান নিরপরাধ হয়েও আমার কমরেডরা শাস্তি ভোগ করবে, এই কথা ভেবে আমার পক্ষে স্বাধীন থাকাটা ছিল অসহনীয়।’

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন আব্রাহাম লিংকনের কথায় পরিসমাপ্তি করা যায়। তিনি মনে করতেন-একদল মানুষ শুধু খাবে, আরেক দল শুধু কাজ করবে-সে উদ্দেশ্য নিয়েই সৃষ্টিকর্তা মানুষ সৃষ্টি করেননি। সবাইকে যেমনি কাজ করতে হবে, তেমনি খাওয়া-দাওয়া আর উপভোগের অধিকারটাও সবার। কোনো শ্রেণিবিশেষের নয়। সেই কথাটি তিনি তুলে সুন্দর করে তুলে ধরেছেন এভাবে- If the Almighty have ever meant a set of men that should do all of the eating and none of the work. He would habe made them with mouths only and no hand and if he had ment another class to do all the work and no eating he would have made them with hands only and no mouth. কি অপূর্ব অনুধাবন। সৃষ্টিকর্তা যদি চাইতেন এক শ্রেণি মানুষ শুধু খাবেই, কাজ করবে নাÑতবে তাদের শুধু মুখই দিতেন, তাদের হাত দিতেন না। অন্যপক্ষে সৃষ্টিকর্তা যদি চাইতেন, এক শ্রেণির মানুষ শুধুই কাজ করবে, খাবে না, তবে সৃষ্টিকর্তা তাদের শুধু হাত দিয়েই পৃথিবীতে পাঠাতেন। মুখ দিতেন না। এই স্বার্থ তাগিদ হলে সবাই নিজ নিজ কাজ করব। সেই সঙ্গে ভোগও করব। কেউ অধিকার পাবে নাÑএমন নিয়মের কোনো স্বীকৃতি নেই। শ্রমিকদের বেলাও এই সত্য চিরন্তন।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist