অধ্যক্ষ ইয়াছিন মজুমদার

  ৩০ এপ্রিল, ২০১৮

নিবন্ধ

লাইলাতু নেসফে মিন শাবান

আরবি শাবান মাসের পরই আসে রমজান। রমজানের প্রস্তুতির মাস হিসেবে তাই শাবান মাসের গুরুত্ব রয়েছে। হাদিস শরিফে নেসফে মিন শাবান তথা শাবানের অর্ধাংশের রজনী অর্থাৎ ১৫ তারিখের রজনী, যাকে ভারতীয় উপমহাদেশসহ কিছু মুসলিম দেশে শবেবরাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর গুরুত্ব বর্ণনায় উন্মুল মুমেনিন আয়েশা (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.)-কে শাবান মাসের মতো এত অধিক সাওম পালন করতে আর কোনো মাসে দেখিনি (বোখারি-মুসলিম)। অর্থাৎ রমজানের প্রস্তুতি ও সাওয়াব লাভের জন্য নবী (সা.) শাবান মাসে বেশি নফল রোজা রাখতেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নবী (সা.) বলেন, এ মাসে রাব্বুল আলামিনের কাছে মানুষের আমল ওঠানো হয়। আমি ভালোবাসি যে রোজা রাখা অবস্থায় আমার আমল আল্লাহর কাছে ওঠানো হোক (নাসাই)। নবী (সা.) আরো বলেন, আল্লাহ তায়ালা মধ্য শাবানের রাতে তার সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন (ইবনু মাজাহ)। এ হাদিসটি আটজন সাহাবির সূত্রে সহিহভাবে বর্ণিত। হাদিসের আলোকে বলা যায়, যে রাতে আল্লাহ বান্দার দিকে দৃষ্টিপাত করেন, ক্ষমা করে দেন সে রাত্রটি ইবাদতে অতিবাহিত করার গুরুত্ব রয়েছে। তবে হাদিসটির মূল শিক্ষা হলো ইবাদত হতে হবে শিরকমুক্ত এবং ব্যক্তিকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে অবশ্যই মুক্ত থাকতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ সমাজব্যবস্থার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও অশান্তি সৃষ্টিকারী।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, হা-মি-ম, সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, আমি একে নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে নিশ্চয় আমি সতর্ককারী এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয় (সুরা আদদোখান, আয়াত : ১-৪)। উল্লিখিত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে কোনো রাতকে বোঝানো হয়েছে এ বিষয়ে দুই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। ইক্রিমা প্রমুখ কয়েকজন তাফসিরবিদ থেকে বর্ণিত এ আয়াতে বরকতের রাত্রি বলে শবেবরাত অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতকে বোঝানো হয়েছে। বিশুদ্ধ মতে ও অধিকাংশ মুফাচ্ছিরের মতে উল্লিখিত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকে বোঝানো হয়েছে। কেননা নবী (সা.) বলেছেন, দুনিয়ার শুরু থেকে আল্লাহপাক যত কিতাব নাজিল করেছেন, তার সব রমজানের বিভিন্ন তারিখে নাজিল করেছেন। সুতরাং ওই আয়াত দ্বারা শাবানের ১৫ তারিখের রাত বোঝানোর সুযোগ নেই। তবে হাদিসে এ রাতের ফজিলত বর্ণিত হওয়ায় এ রাতে ইবাদত করার গুরুত্ব রয়েছে। এ-বিষয়ক হাদিসগুলোর অধিকাংশের সনদে দুর্বলতা থাকলেও এ ধরনের হাদিস দ্বারা আমল করার সুযোগ রয়েছে। অর্ধ শাবান মাসের ইবাদত ও ফজিলত সম্পর্কিত বর্ণনার মধ্যে রয়েছে নবী (সা.) বলেছেন, যখন শাবান মাসের অর্ধরাতের আগমন ঘটে, তোমরা দিনে রোজা রাখবে এবং রাতে ইবাদতে দ-ায়মান হবে। কেননা অর্ধ শাবানের রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহপাক দুনিয়ার আকাশে (প্রথম আকাশে) অবতরণ করে ঘোষণা করেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী

আছো কি? থাকলে আমি ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক প্রার্থী আছো কি? আমি রিজিক বাড়িয়ে দেব। কোনো অপরাধী আছো কি? আমি অপরাধ মুছে দেব। এভাবে বিভিন্ন বিষয়ে প্রার্থনার ঘোষণা দিতে থাকেন, এ ঘোষণা ফজর পর্যন্ত চলতে থাকে (ইবনু মাজাহ)।

নবী (সা.) ফরজ নামাজ মসজিদে জামায়াতের সঙ্গে আদায় করার জন্য জোর নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু সুন্নত নফল ঘরে আদায় করাকে উত্তম বলেছেন। নফল ইবাদত প্রকাশ্যে করলে লোক দেখানোর সুযোগ থাকে অর্থাৎ এতে রিয়ার সুযোগ হয়। তাই নফল ইবাদত নিরিবিলি ঘরে আদায় করাই উত্তম, আমাদের দেশের মানুষকে এ সুযোগ দিলে তারা ঘুমিয়ে পড়বে, তাই ভারতীয় উপমহাদেশসহ কতিপয় দেশে শবেবরাতে মসজিদে সমবেত হয়ে ইবাদত করার প্রচলন করা হয়েছে। তবে আল্লাহর প্রেমিক বান্দাহদের শুধু শবেবরাত ও শবেকদরের প্রচলিত ইবাদতে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বোখারি ও মুসলিম শরিফে উল্লিখিত বিশুদ্ধ হাদিসে দেখা যায় নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহপাক প্রত্যেক রাতের এক-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ হয়ে ঘোষণা করেন, আমি রাজাধিরাজ, আমি রাজাধিরাজ, যে আমাকে আহ্বান করবে আমি সাড়া দেব, যে আমার কাছে কিছু চাইবে আমি প্রদান করব, যে ক্ষমা চাইবে আমি ক্ষমা করবÑএভাবে ফজর উদয় পর্যন্ত ঘোষণা করা হতে থাকে। ওই হাদিসের আলোকে উচিত শুধু শবেবরাত, শবেকদরের প্রচলিত ইবাদতে সীমাবদ্ধ না থেকে তাহাজ্জুদের নামাজে নিয়মিত হওয়া ও রাত্রিকালীন প্রার্থনায় অভ্যস্থ হওয়া আবশ্যক। প্রত্যেক মাসের মধ্যবর্তী তিন দিন রোজা রাখার গুরুত্ব রয়েছে, যাকে আইয়ামে বীজের রোজা বলা হয়, তাই শুধু শবেবরাতের প্রচলিত রোজায় সীমাবদ্ধ না থেকে আইয়ামে বীজের রোজায় অভ্যস্থ হওয়া উচিত। অন্যদিকে এ রাতে নামাজের কোনো নির্ধারিত নিয়ম বা ইবাদতের কোনো নির্ধারিত নিয়ম বর্ণিত নেই। যার যার সুবিধামতো ইবাদত করবে। তবে শৃঙ্খলার জন্য মসজিদের ইমাম সাহেব বা কর্তৃপক্ষ হয়তো সময়সীমা বেঁধে দেন সেটা স্বতন্ত্র বিষয়, আবার অনেকে আলোকসজ্জা বা হালুয়া-রুটি ইত্যাদিকে এবং সন্ধ্যায় গোসল করাকে অনেক পুণ্যের মনে করে, যার কোনো ভিত্তি নেই। অন্যদিকে অনেকে আঁতশবাজি ও ফটকা ফুটায়, যা এ রাতের পবিত্রতাকে বিনষ্ট করে। আমাদের ইবাদত হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য, যেমনÑমাওলানা রুমী কেনিয়ার জঙ্গলে গভীর রাতে কেঁদে কেঁদে বলতেন, আহরাদর, আসেমা হাম দম না বুদ, রাজেরা গায়রে খোদা মাহরুম না বুদ, (রাত্রি নিশিতে যখন কাঁদি আকাশ ছাড়া কেউ থাকে না, আমার কাঁদার ভেদের কথা খোদা ছাড়া কেউ জানে না)। আমাদের ইবাদত হওয়া উচিত আল্লাহর প্রেমে যেমন রাবেয়া বছরী বলেছেন, তুজান্নাত রা বনেকা দেহ ওয়া মান বদ রা দোজখ বর, কেহ বাছ বাশাম আজা মুরা তামান্নায়ে দিদারতু (হে খোদা তুমি তোমার সুখের স্বর্গ সব নেককারকে দিয়ে দাও, আমি তোমার না খান্দা দাসী, আমাকে নরকেই পাঠাও কিন্তু তোমার প্রেমের দোহাই যেখানেই পাঠাও আমি যেন তোমার দিদার থেকে বঞ্চিত না হই। তাই আমাদের ইবাদত শুধু নির্দিষ্ট দিবসে সীমাবদ্ধ না থেকে সব কাজে, সব সময়ে, রিয়া মুক্তভাবে ও আল্লাহর সত্যিকার প্রেমিক এবং আবেদ হওয়ার জন্য হোক।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist