ইফতেখার আহমেদ টিপু
মতামত
রোহিঙ্গা সংকট ও টেকসই সমাধান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ টেকসই এবং দ্রুত সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কমনওয়েলথ সম্মেলন উপলক্ষে লন্ডনে অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের গবেষণা সংস্থা ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন : নীতি, অগ্রগতি ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে দেওয়া বক্তব্যে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সাম্প্রতিক সময়ে নির্যাতনের মাধ্যমে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পুরো চাপ বাংলাদেশ একাই সামলাচ্ছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন প্রায় ১১ লাখ। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশকে ত্রিশঙ্কু অবস্থার শিকার করেছে। ক্ষুদ্র জেলা কক্সবাজারে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে এবং আশ্রিতদের সংখ্যা সার্কভুক্ত দেশ ভুটানের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়দান পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। কক্সবাজার ও সংলগ্ন জেলাগুলোর পাহাড় টিলা কাটা হয়েছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। তাদের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে গাছপালা উজাড় হয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ নয়। রোহিঙ্গারা রাখাইনে বসবাস করে আসছে শত শত বছর ধরে। রাখাইনে মিয়ানমারের দখলদারিত্বের অনেক আগে থেকেই রোহিঙ্গারা সেখানে বসবাস করে এসেছে মর্যাদার সঙ্গে। মধ্যযুগের রাখাইন বা আরাকানে রোহিঙ্গাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদন হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুরোধে। নিজেদের জন্য ভয়াবহ সমস্যা জেনেও মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেওয়ার ঔদার্য দেখিয়েছে। এখন এ সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘসহ বিশ্বসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধানের পথ উন্মোচনে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হওয়ায় এ ব্যাপারে ৫৩ জাতির এই জোটের সদস্যদের এগিয়ে আসার দায় রয়েছে।
জাতিগতভাবে নিধনের উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে কয়েক দশক ধরে। কিন্তু গত ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে এবং সর্বশেষ গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে অভিযানের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে নির্মমভাবে। সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা, ধর্ষণের শিকার হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী। সহিংসতার ঘটনায় প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে থেকেই আরো অন্তত চার লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা এবং মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি সংহতি এবং রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের তাগিদ জানিয়ে আসছে বিশ্ব সম্প্রদায়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য গত বছরের ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী গত ২২ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা শুরু হয়নি। এমনকি কবে থেকে শুরু হবে তাও নির্দিষ্ট করে জানা যাচ্ছে না। কাজেই প্রত্যাবর্তনে প্রক্রিয়া শুরু বা সম্পন্ন হওয়া নিয়ে একটা বড় আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ১২ জানুয়ারি ভ্যাটিকান সিটি সফরে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হলেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
আশার কথা হলো, এখনো আন্তর্জাতিক মহল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে তৎপর রয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কূটনীতিকরা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পরিদর্শন করেছেন। এ ছাড়া সফরে এসেছেন সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট অ্যালেইন বারসেত, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন ও ইইউ প্রতিনিধিদল। রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা বিবেচনায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তদারকি করার জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত করেছে। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ঘনীভূত হচ্ছে।
সবারই প্রত্যাশা, শুধু বৈঠক আর আলোচনাতেই যেন তৎপরতা সীমাবদ্ধ থেকে না যায়। প্রস্তুতিমূলক সব কাজ অতিদ্রুত সম্পন্ন করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার। অন্যদিকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার পাশাপাশি সে দেশে তাদের নিরাপদ বসবাসের পরিবেশ ও নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টিও জরুরি। এ ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত থাকবে-এটাই আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ
"