মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ২৯ এপ্রিল, ২০১৮

নিবন্ধ

মুক্তির সওগাত শবেবরাত

শাবান আরবি মাসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি মাস। প্রিয়নবী (সা.) এ মাসকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের বুনিয়াদ রোজা পালনের মাস মাহে রমজানের পূর্ববর্তী মাস যেহেতু এই শাবান মাস, তাই এ মাসটি হলো পবিত্র রমজান মাসে একাগ্রচিত্তে সিয়াম-সাধনা ও অধ্যবসায়ের প্রস্তুতি গ্রহণের মাস। শাবান মাসের বরকত ও ফজিলত অনেক। এর অন্যতম কারণ হলো, এ মাসের ১৪তম তারিখ রাতেই হয়ে থাকে বিশ্বসৃষ্টির মুক্তি ও ভাগ্য নির্ধারণের বিশেষ ও বরকতপূর্ণ রজনী ‘শবেবরাত’ বা লাইলাতুল বরাত। এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে এবং ইবাদতের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘পনেরো শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ রাত) যখন আসে, তখন তোমরা তা ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং পরদিন রোজা রাখ। (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৪)। এ মাস এলে প্রিয়নবী (সা.) স্বীয় আমলের পরিমাপ স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অধিক বাড়িয়ে দিতেন। উম্মুল মু’মিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘একবার রাসুল (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন, আমার আশঙ্কা হলো, তার হয়তো ইন্তেকাল হয়ে গেছে। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, ‘হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা! তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসুলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। নবীজি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তিনি তখন বললেন, এটা হলো অর্ধ শা’বানের রাত। (শা’বানের চৌদ্দ তারিখের রাত)। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। (বায়হাকী ৩/৩৮২,৩৮৩)। উপরোক্ত হাদিস থেকে এ রাতের ফজিলত যেমন জানা যায়, তদ্রƒপ এ রাতের আমল কেমন হওয়া উচিত তাও বোঝা যায়।

হাদিসে এ রাতকে বলা হয়েছে, ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবানের অর্ধ মাসের রাত। আবার কোথাও বলা হয়েছে, ‘লাইলাতুল বরাত’ বা মুক্তির রজনী। হজরত জালালুদ্দিন মহল্লী (রাহ.) এ রাতের আরো দুটি নামের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে, ক. ‘লাইলাতুল রাহমাত’ বা করুণার রাত। খ. ‘লাইলাতুস সাফ’ বা চুক্তিনামার রাত। (জালালাইল : ২/৪১০)। কেননা, এ রজনীতে সমগ্র সৃষ্টির প্রতি পরম দয়াময়ের পক্ষ থেকে তার অপার করুণার বান বয়ে যায় এবং মানুষের জীবন-মরণ ইত্যাদি অন্যান্য বিষয়ে অজস্র চুক্তিনামা বা দলিলাদি স্বাক্ষরিত হয়। এ রাতকে শাফায়াতের রাতও বলা হয়। লাইলাতুল বরাত অধিক মর্যাদাপূর্ণ রাত। এ রাতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অনেক বরকত নাজিল হয়। অসংখ্য নেকি দান করা হয়। অনুগ্রহ ও দয়ার ভা-ার খুলে দেওয়া হয়। গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়। বিশেষ করে এ রাত গুনাহের কাফফারা হিসেবে পরিগণিত হয়।

মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে অবস্থানকালীন সময়ে কীভাবে চলতে হবে এবং কী কী আমল করতে হবে এবং কোন কোন কাজ পরিহার করতে হবে তা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন। তবু মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অনেক পাপ করে থাকে। আল্লাহ বড়ই দয়ালু। তিনি চান অপরাধ করার পর বান্দাদের একটি সুযোগ দিতে, যাতে তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে তাওবা করে। তাই তারা যদি এ রাতে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তবে তিনি ক্ষমা করে দেবেন। আর এ জন্য রাতটি ক্ষমাপ্রার্থনার রাত। সুতরাং পাপী পারে এ রাতে ক্ষমা চেয়ে নিতে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে। হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, শাবানের চৌদ্দ তারিখ রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৪)। তবে এ ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে, এ রাতের নফল আমলসমূহ, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। ফরজ নামাজ তো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদিস শরিফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (মারাকিল ফালাহ : ২১৯)। দুঃখজনক হলেও সত্য, শবেবরাত একটি পূর্ণময় রজনী হওয়া সত্ত্বেও নানা পারিপার্শ্বিক কারণে তাতে এমন কিছু কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। অন্যথায় এসব কার্যাবলি আমাদের ইহ ও পরকালের জীবনে কল্যাণ ও মুক্তির পরিবর্তে অকল্যাণ ও বিপদ বয়ে আনবে। যেমন : ১. আতশবাজি। ২. হালুয়া-রুটির বিশেষ আয়োজন। ৩. প্রয়োজনাতিরিক্ত আলোকসজ্জা। ৪. মাজারে বা গোরস্তানে মেলা উৎসব করা। ৫. একাগ্রতার প্রতি লক্ষ না দিয়ে ইবাদত ইত্যাদিতে বাহ্যিক জাঁকজমকের দ্বারা অনুষ্ঠানসর্বস্ব করে তোলা।

এ রাতে দয়াময় আল্লাহ অসংখ্য মানুষের অপরাধ ক্ষমা দিলেও খাঁটি অন্তরে তাওবা করা পর্যন্ত নিম্নবর্ণিত অপরাধীদের ক্ষমা করবেন না বলে কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। ১. মুশরিক, ২. জাদুকর, ৩. গণক, ৪. হিংসুক, ৫. গায়ক-গায়িকা, ৬. যারা বাদ্যযন্ত্র বাজায় ও বানায়, ৭. রেখা টেনে ফালনামা দেখে ভাগ্য ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী, ৮. আত্মীয়তা ছিন্নকারী, ৯. পরস্পর শত্রুতা পোষণকারী, ১০. জালেম শাসক ও তার সহযোগী, ১১. মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয়কারী, ১২. পায়ের গিরার নিচে গর্বসহকারে জামা পরিধানকারী, ১৩. মদ্যপ, ১৪. পরস্ত্রীগামী, ১৫. মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, ১৬. কৃপণ, ১৭. পরনিন্দাকারী, ১৮. অন্যায়ভাবে শুল্ক আদায়কারী। এ ছাড়া আরো অনেক অপরাধীর কথা বর্ণিত হয়েছে। যার সব কটি গুনাহে কবিরা। শবেবরাত ও শবেকদরের বরকতে সগিরা গুনাহ মাফ হয় বটে, তবে গুনাহ থেকে ক্ষমা পেতে হলে খাঁটি মনে তাওবা করা আবশ্যক। এ বরকতময় রাতে যেন আমরা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতে পারি, কোরআন তিলাওয়াত করতে পারি, দেশ-জাতি ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য দোয়া করতে পারি, আল্লাহ আমাদের সে তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist