রায়হান আহমেদ তপাদার
আন্তর্জাতিক
যুদ্ধ নয়, শান্তির পথই কাম্য
ইসরায়েলি দৈনিক জেরুজালেম পোস্ট লিখেছে, এর ফলে ইসরায়েলের বিমানবাহিনী হুমকির মুখে পড়বে। আরো বেশি ইসরায়েলি পাইলট প্রাণ হারাবে। ইসরায়েলি টিভি চ্যানেল আইটুয়েন্টিফোর নিউজ লিখেছে, সিরিয়ার কাছে রাশিয়ার এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি ঠেকাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইসরায়েলের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে বলে ইসরায়েলের অন্যান্য গণমাধ্যমেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। রুশ সামরিক বাহিনীর শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা কর্নেল সের্গেই রুদস্কয় গত শনিবার বলেছেন, আগে থেকেই অস্থির অবস্থায় থাকা মধ্যপ্রাচ্যকে আরো অস্থিতিশীল করে তোলার জন্যই পশ্চিমা দেশগুলো সিরিয়ার ওপর হামলা চালিয়েছে। সিরিয়া প্রশ্নে মার্কিন নীতিকে বিভ্রান্তিকর হিসেবে উল্লেখ করে আরতি বালি বলেন, এ ধরনের নীতি সিরিয়া সংকটকে অবান্তর করে তুলেছে। এক বছর আগে সিরিয়ায় ট্রাম্প প্রশাসনের নির্দেশে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়, এ বছর চলতি মাসেই তিনি ঘোষণা দেন সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা ফিরিয়ে নেওয়ার এবং ফের তিনি দেশটিতে হামলার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর এ হামলা করা হলো যখন সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যখন প্রায় শেষপর্যায়ে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা ফিরিয়ে নিতে চাইলেও দামাস্কাসের স্থিতিশীলতায় রাশিয়া ও ইরানের আসাদ সরকারকে সহায়তার পরিপ্রেক্ষিতে পেন্টাগনের সেনা কর্মকর্তারা দেশটি থেকে তাদের সেনা ফিরিয়ে নিতে চায়নি। মার্কিন জেনারেল জোসেপ ভোটেলের কথায় তার প্রমাণ মিলেছে এমপাওয়ার মেন্টের (এসপিআরই) এক সিনিয়র সদস্য আরতি বালি সিরিয়ায় মার্কিন হামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, এ ধরনের হামলা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে দশকের পর দশক অস্থিতিশীল করে তুলবে।
ইরানের বার্তা সংস্থা ইরানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরতি বালি বলেন, সিরিয়াকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ক্রমেই যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে এবং সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলা কারা করছে তা তদন্তে মার্কিন ও রাশিয়ার উদ্যোগ পরস্পরের বিরোধিতায় আটকা পড়ে যাচ্ছে। এর ফলে সিরিয়ায় স্থিতিশীল পরিস্থিতির ব্যাপারে এক গভীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে এবং ট্রাম্পের সামরিক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে তা আরো জটিল ও সংকটজনক হয়ে পড়ছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্য যে শুধু অশান্ত হয়ে উঠবে, তা নয় বরং এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে এশিয়াতেও। সিরিয়া সংকটের জন্য মার্কিন ও দেশটির মিত্রদের দায়ী করে আরতি বালি বলেন, দেশটিতে সন্ত্রাসীদের যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, বিমান হামলা ও অন্যান্যভাবে সহায়তা করছে। অন্যদিকে সিরিয়ার ডুমা আসাদ বিদ্রোহীদের দখলে থাকা সত্ত্বেও সেখানে রাসায়নিক হামলার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সিরিয়ায় রাসায়নিক বোমা তৈরির মতো কোনো স্থান থাকলে বা এর সঙ্গে আসাদ বিদ্রোহীরা জড়িত আছে কি না কিংবা তারা পশ্চিমা সামরিক হামলার পটভূমি তৈরি করছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। যখন ট্রাম্প তার সৈন্য সিরিয়া থেকে প্রত্যাহার করতে চাচ্ছেন, তখন আসাদ কেন রাসায়নিক হামলা চালাবেন সেও এক প্রশ্ন। এদিকে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফরকে তেহরানের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে আরতি বালি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব তার প্রভাব হারাচ্ছে, ইয়েমেনে মার্কিন সহায়তায় আগ্রাসন চালানোর কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং সে কারণেই দেশটি ইরান ও সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ইরাকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের হাত করতেও চেষ্টা করছে সৌদি আরব।
ক্রাউন প্রিন্সের যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, মিসর ও ফ্রান্স সফর প্রতিফলিত হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের সিরিয়ায় হামলার বিষয়টিতে। অন্যদিকে রাশিয়া, চীন ও ইরান সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন সৌদি আরব ও ইসরায়েল তার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে কাজ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অবিচল রাখতে কৌশলগত স্বার্থেই কাজ করছে তেলআবিব ও রিয়াদ। আর এর লক্ষ্যই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাবকে খর্ব করা। আরেকবার রাসায়নিক হামলার চেষ্টা হলে, সিরিয়ায় ফের আক্রমণ চালাতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র। রাজধানী দামেস্কে প্রথম দিনের অভিযান সফল দাবি করে, বাশার আল-আসাদের প্রতি এ হুশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হামলার পরপরই, জাতিসংঘে জরুরি বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়া ও সিরিয়ার উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। অন্যদিকে নিরাপত্তা পরিষদে মস্কোর নিন্দা প্রস্তাব ভেস্তে যায় ওয়াশিংটনের ভেটোতে। সিরিয়া পরিস্থিতি আরো জটিল না করতে বিবদমান পক্ষগুলোকে আহ্বান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সিরিয়ার দুমায় রাসায়নিক হামলার অভিযোগে, দামেস্কে অন্তত ১০৫টি মিসাইল ছোড়ে মার্কিন, ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনী। হামলায় আসাদ সরকারের রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদের বড় অংশ ধ্বংসের দাবি করে পশ্চিমা দেশগুলো। অবশ্য, অধিকাংশ মিসাইলই ভূপাতিত করে দেওয়া হয়েছে বলে পাল্টা দাবি সিরিয়া ও মিত্র রাশিয়ার। এক সপ্তাহ তীব্র উত্তেজনা ও বাকযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সিরিয়ার বিভিন্ন অবকাঠামো ও স্থাপনার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। বাশার আল-আসাদ সরকার আর যাতে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে না পারে, সে উদ্দেশ্যেই এ হামলা বলে পশ্চিমারা দাবি করেছে।
গত ৭ এপ্রিল সিরিয়ার পূর্ব গৌতায় বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডোমা শহরে রাসায়নিক হামলা হয়। এতে বহু লোক নিহত হয়। মানবাধিকার কর্মী ও চিকিৎসকরা জানান, সরকারি বাহিনী এই রাসায়নিক হামলা চালায়, যাতে অনেকে নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এই রাসায়নিক হামলার জন্য সরকারি বাহিনী ও রাশিয়া দায়ী। বাশার আল-আসাদ সরকার ও রাশিয়া এ অভিযোগ অস্বীকার করে। রাশিয়া দাবি করে, ডোমায় কোনো রাসায়নিক হামলাই হয়নি। গত বৃহস্পতিবার ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জানান, ডোমায় সিরীয় সরকার যে রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে, তার প্রমাণ তার কাছে আছে। ওদিকে রাসায়নিক হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। হামলার জবাব হিসেবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হবে বলে জানান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এক টুইটে তিনি ক্ষেপণাস্ত্র আসছে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। রাশিয়া পাল্টা হুমকি দিয়ে বলে, সিরিয়ার দিকে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠালে ভূপতিত করা হবে। এর জবাবে ট্রাম্প বলেন, প্রস্তুত হও রাশিয়া। এই বাকযুদ্ধের মুখে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। পেন্টগনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মোট তিনটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে। একটি হচ্ছে দামেস্কের কাছে রাসায়নিক অস্ত্রপ্রস্তুতকারী গবেষণাগার। অন্য দুটি হলো হোমসে রাসায়নিক অস্ত্ররক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র ও রাসায়নিক অস্ত্রের যন্ত্রাংশ সংরক্ষণ কেন্দ্র। রাশিয়ার দাবি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যৌথভাবে ১০০টির মতো এয়ার-গ্রাউন্ড ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
পূর্ব গৌতার ডুমায় বাশার আল-আসাদ সরকারের রাসায়নিক হামলা এই প্রথম নয়। ২০১৩ সালের আগস্টে একইভাবে রাসায়নিক হামলা চালানো হয়, যাতে বহুলোক নিহত হয়। শুধু তা-ই নয়, গত বছর শেইকুনে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিব গ্রামে সরকারি বিমানবাহিনী সারিন গ্যাস হামলা চালায়। সেখানেও অনেক লোক হতাহত হয়। বলাবাহুল্য, ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বাশার আল-আসাদের বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে আসছে। এই সঙ্গে চলছে উৎপীড়ন ও বিতাড়ন। এ পর্যন্ত পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। লাখ লাখ মানুষ ঘর-বাড়ি-সহায় সম্পদ হারিয়ে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন। পালানোর সময় সিরীয় কত শিশু ও নাগরিকের যে সাগারে সলিল সমাধি হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। শিশু আইলানের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা বিশ্ববাসী কখনো ভুলতে পারবে না। এটা অনেক আগেই প্রতীয়মান হয়েছে, বাশার আল-আসাদ সরকারকে সরিয়ে নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারলেই কেবল সিরিয়ায় শান্তি ফিরে আসতে পারে। বাশার আল-আসাদের সরকারের পতনের মাধ্যমেই অবসান হতে পারে গৃহযুদ্ধের, অবসান হতে পারে হত্যা, নির্যাতন, শরণার্থী হওয়ার মতো দুর্বিষহ অধ্যায়ের। অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক বাস্তবতা এই যে, এই ‘সমাধান সূত্রটি’ জানা থাকার পরও পশ্চিমা শক্তিচক্র ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মিত্ররা গত সাত বছরে কিছুই করতে পারেনি। বাশার আল-আসাদ সরকারের অপসারণ বা পতনে কোনো কঠোর ও কার্যকরযোগ্য ব্যবস্থা নিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তেমন ব্যবস্থা নিলে অনেক আগেই সিরিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসত। যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসনের দায়সারা ও লোক দেখানো উদ্যোগ-পদক্ষেপ বাশার আল-আসাদ সরকারকে বাধ্য ও নমিত করতে পারেনি। গৃহযুদ্ধ এত দিন প্রলম্বিত হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররাই দায়ী। তাদের মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের অভিমতও এটা। ইতোমধ্যে বাশার আল-আসাদ সরকার তার নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধি করার সুযোগ পেয়েছে, মিত্রদের বিশেষ করে ইরান ও রাশিয়ার নিরঙ্কুশ সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। এমতাবস্থায় ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যুদ্ধ নয়, সমঝোতা ও শান্তির পথই কাম্য।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
"