নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

বিশ্লেষণ

পলিব্যাগ ও দূষণমুক্ত নগর

ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। ফলে এগুলো আবর্জনায় রূপান্তরিত হয়ে ড্রেন, নালা-নর্দমা ভরাট করে পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন একটি নীরব ঘাতক। পলিথিন শত শত বছর পড়ে থাকলেও পচে না বা মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। আর নগর জীবনে সবচেয়ে ক্ষতিকারক দিক হলো, যত্রতত্র পলিথিন ফেলে রাখলে তা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায়। ঢাকা শহরের পয়োনিষ্কাশনের শতকরা ৮০ ভাগ ড্রেনে পলিথিন ব্যাগ জমাট বেঁধে আছে। আর এসব রোধ করতেই ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত)-২০০২ অনুযায়ী ১০০ মাইক্রনের কম পুরুত্বের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। এই আইন অমান্য করলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা আর বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেল এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।

প্রতি বছর ২২ এপ্রিল পালিত হয় বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। প্রতিটি ধরিত্রী দিবসেই বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার উদ্যোগে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। প্রকৃতি ও পরিবেশের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় দুই কোটি লোক রাস্তায় নেমে আসে। সে বছর থেকেই বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। পরিবেশগত অধিকার আদায়ে বিশ্ব ধরিত্রী দিবস পালন করে আর্থ ডে নেটওয়ার্ক। সংস্থাটি ১৯২টি দেশে কাজ করছে। এ কাজের মাধ্যমে লক্ষাধিক মানুষকে জানানো হচ্ছে প্লাস্টিক ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ঝুঁকি। ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের সংস্থা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড কাউন্টস’ বলছে, বিশ্বে প্রতি বছর পাঁচ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। এগুলোকে একটার পর একটা করে সাজিয়ে রাখলে ফ্রান্সের সমান আয়তনের দুটি দেশকে ঢেকে দেবে।

নিয়মিত প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে ভয়াবহ করে তুলছে। পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালি প্লাস্টিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশির ভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না। শুধু আমেরিকায় প্রতি বছর ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা হয়। এগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ পুনঃচক্রায়ন হয়ে থাকে। বাকি ৩.৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের বিরুদ্ধে যুগোপযোগী আইনপ্রণয়ন করা হয়েছে। সম্প্রতি ১৭টি পণ্যের মোড়কজাতকরণে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক মাটিতে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে, যা ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠীয় পানির সঙ্গে মিশে আমাদের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ে। এভাবেই পানি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন অণুজীব প্লাস্টিক অণু ভেঙে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে। মিথেন এক প্রকার গ্রিন হাউস গ্যাস, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। ২০১২ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, সমগ্র বিশ্বের সমুদ্রে আনুমানিক ১৬৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আছে। প্লাস্টিক দূষণ প্রাণিকুলের খাদ্যচক্রের ওপর বিশেষ করে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর বেশি বিরূপ প্রভাব ফেলে। সামুদ্রিক কচ্ছপ সাধারণত জেলিফিস ও সামুদ্রিক কীট খেয়ে জীবন ধারণ করে। জেলিফিশের আকার ও আকৃতি প্লাস্টিক ব্যাগের মতো হওয়াতে কচ্ছপ ভুল করে প্লাস্টিক ব্যাগ ভক্ষণ করে। এতে তাদের খাদ্যনালি বন্ধ হয়ে যায় এবং খাদ্য গ্রহণ করতে না পারায় ধীরে ধীরে মারা যায়। প্লাস্টিক দূষণের ফলে কচ্ছপের চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামুদ্রিক তিমি ও ছোট মাছ। সামুদ্রিক তিমি ও সামুদ্রিক ছোট মাছের পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এ জন্য প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক মৎস্য প্রজাতির জন্য হুমকি স্বরূপ।

সামুদ্রিক প্রাণীকে বিষাক্ত ও আহত করার পাশাপাশি খাদ্যপণ্যে প্লাস্টিকের সর্বব্যাপী উপস্থিতি মানব জীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে। জীবন ধ্বংসকারী নানা রোগ ও আগাম বয়োসন্ধির কারণ হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রহের টিকে থাকাও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।

পরিবেশ দফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৩ সালে সারা দেশে প্রতিদিন ৪৫ লাখ পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার হতো। ২০০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ লাখে। আর ব্যবসায়ীদের দাবি, এখন প্রতিদিন সারা দেশে আনুমানিক ১ কোটি ২২ লাখের বেশি পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার হচ্ছে। শুধু আইন প্রয়োগ করেই প্লাস্টিক দূষণ রোধ করে পরিবেশবান্ধব টেকসই নগর গড়া যাবে না। এ জন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক কাঠামোর প্রতি সমর্থন আদায়ে তৃণমূল পর্যন্ত আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন উদ্বুদ্ধ ও সক্রীয় করে সরকার ও করপোরেশনগুলোর কাছে প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ ও দূষণ বন্ধের দাবি তুলতে হবে। বিশ্বব্যাপী মানুষের প্লাস্টিক বর্জন, ব্যবহার কমানো, পুনর্ব্যবহার ও পুনর্নবায়নের জন্য নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণেও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist