বিশ্বজিত রায়

  ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

মতামত

দুর্নীতির মহাতঙ্কে হাওরবাসী

ফসলি প্লাবনে আনন্দে আত্মহারা হাওরপারের মানুষ। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা সন্তোষজনক হওয়ায় হাওরে বইছে খুশির বান। বেদনাবিরহ ব্যাকুলতা ডিঙিয়ে চাষা হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে বাড়তি ফলনের উচ্চাবিলাসী ভাব। মেঘে ঘনঘটা কালো আভা সরিয়ে কৃষকের আকাশে দেখা মেলেছে সাতরঙা রংধনু। ধান কাটার মহাধুমধাম ক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে বিপন্ন জীবনের অসহায় কা-ারি হাওরের অগণনীয় চাষা। মরেও বেঁচে থাকা হাওরি মানুষগুলো এবার ধনুকরঙা রঙিন অবয়বে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনছেন। সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় খোঁজে পেয়েছেন ফলনভর্তি সুখের ভরসা। ভাগ্যভগবান বুঝি এবার কৃষকপানে চোখ মেলে তাকিয়েছেন। গত বছরের দুঃখ-দুর্দশা গুছিয়ে ধান্যদেবী এবার কৃষকের শূন্যঘর ভরিয়ে দেবেন সোনালি ফলনে। হাওরের সোনাঝরা ধান্য হাসি যেন তাই বলে যাচ্ছে। খুশ মেজাজে থাকা কৃষকের অঙ্গভঙ্গি ও কর্মব্যস্ততার দ্রুত গতিসম্পন্ন রেশ বলে দিচ্ছে ‘কথা কম কাজ বেশি’ প্রেক্ষিত বাস্তবতা। হাওরে হাওরে চলছে ধান কাটার মহোৎসব। কৃষক থেকে কৃষাণী সবাই ফলন তুলতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তৃপ্ত মনে কাজ করে চলেছেন তারা। তাদের হৃদ মৌনতায় শুধু অনুকূল প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রার্থনা।

প্রকৃতি অনুকূলে থাকলে এপ্রিলের মধ্যেই হাওরে ধান কাটা প্রায় শেষের দিকে চলে যাবে। তারপর মে মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত চলবে সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ। গত ৮ এপ্রিল বোরো ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে সরকার। সাধারণত উৎপাদন খরচের ওপর ভিত্তি করে সরকার ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। এবার বোরো চালের উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ টাকা। গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে তা ছিল ৩১ টাকা এবং ২০১৬ সালে ছিল ২৯ টাকা। ধানের দাম প্রতি কেজি এবার নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা। ২০১৭ সালে তা ছিল ২২ টাকা এবং ২০১৬ সালে ছিল ২০.৭ টাকা। বীজ, বালাই ব্যবস্থাপনা, সেচ, পারিবারিক ও ভাড়াকৃত শ্রম এবং জমির ভাড়া বাবদ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছরের তুলনায় এবার বোরো ধান উৎপাদন ব্যয় ৯.১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ব্যয় বৃদ্ধির কথা চিন্তা করেই হয়তো ধান ও চাল সংগ্রহে সরকার কিছুটা দাম বাড়িয়েছেন। সরকারের এ উদ্যোগ ইতিবাচক হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। তবে লক্ষ রাখতে হবে হাওরের ধানক্রেতা ফড়িয়াবাজ শ্রেণি কোনো প্রকারেই যেন কৃষকের সঠিক প্রাপ্যতায় ভাগ বসাতে না পারে। কৃষকরা যাতে সেই নির্ধারিত মূল্যের ন্যায্যতা পায়, সেদিকে নজর দেওয়া অবশ্যই জরুরি।

গত বছর এই দিনে হাওরে হাহাকার আর্তনাদের করুণ ক্রন্দন শোনা গিয়েছিল। এক অসহনীয় যন্ত্রণার ব্যথাব্যাকুল পিঠে চেপে বসেছিল হাওরবাসী। শান্তি সুখের উৎপাদনশীল পণ্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর ডুবন্ত হাওরপারে বসে শুধুই কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন ভাটির বেদনাতুর লাখো কৃষক। আগামীর কথা চিন্তা করে মাথা চাপড়েছেন আর ভাবনার অকূল দরিয়ায় ভরসা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। হাওরের এই ফসলশূন্য পারে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভ্রান্ত সান্ত¦নার সোনালি ডোরে আবদ্ধ করে বেদনাবিদীর্ণ বক্ষে গুঁজেছেন ভবিষ্যৎ ফলনের বীজ। গত মৌসুমের সর্বনাশী চৈতের আগাম আস্ফালন অর্থাৎ মঙ্গাপীড়িত পানিতে ভাসিয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল হৃদয়বিদারী আর্তনাদ। ভাটির এই মহাবিপর্যয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে কড়া নেড়েছে। তখন হাওর পারে জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শনে আসতে বাধ্য করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান রাষ্ট্রনেতা প্রধানমন্ত্রীকে পেয়ে হাওরবাসী আশ্বস্ত হয়েছিল, মানুষ না খেয়ে মরবে না এবং হাওরের বাঁধ রক্ষাকাজে দুর্নীতির রাঘববোয়াল ও চুনোপুঁটিদের খোঁজে বের করা হবে, বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে তাদের।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ধানের দেশ সুনামগঞ্জসহ হাওরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সত্যিই না খেয়ে মরেনি। পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য অভাবগ্রস্ত কৃষিজীবী মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারের অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া খাদ্যখোড়াক হাওরি জনপদে এনে দিয়েছে স্বস্তি ও শান্তি। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার এ খাদ্য সহায়তা হাওরের মানুষকে অনাহারীর কবল থেকে রক্ষিলেও মানুষ পায়নি হাওরবিনাশী বিচার। হাওর কল্যাণে ছাড় দেওয়া সরকারের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের বিচার সম্পর্কিত কোনো সন্তোষজনক উপমা তুলে ধরতে পারেনি সরকার। ফসল তলিয়ে যাওয়া পরবর্তী সময়ে সরকারের তরফ থেকে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব পোষণ করাসহ দুর্নীতির চিহ্নিত রাঘববোয়ালদের ধরপাকড় ও দৌড়ের ওপর রাখলেও শেষ পর্যন্ত এ তৎপরতা লোকদেখানো মহরত ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। অভিযুক্তদের বিরদ্ধে সরকারের অবস্থান কোন পর্যায়ে আছে, সেটাও প্রায় অজানা। গত বছরের হাওর তলানো দুঃখকথা বাদ দিয়ে সরকার এবার হাওর রক্ষায় হাতে নিয়েছে ফলনপ্রাপ্তির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। বিগত বছরে অসময়ের পানিতে তলিয়ে যাওয়া হাওর সর্বনাশী দুর্যোগে বিপর্যস্ত হাওরের অরক্ষিত বাঁধ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে ভাটির জনপদে তুষ্টির ছায়া নেমে এসেছে। সরকারের কৃষিবান্ধব বাঁধ রক্ষা কাজের গতি প্রকৃতি মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। হাওর বাঁধের সার্বিক ব্যবস্থাপনা হাওরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেও বাঁধ রক্ষা কাজে সম্পৃক্ত পর্দার অন্তরালে অবস্থান করা গত বছরের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ পিআইসিওয়ালারা এবারো বাঁধে উড়িয়েছেন দুর্নীতি নিশান। দুর্নীতির দুর্বার প্রতিযোগিতায় ঢেউ তোলা ঠিকাধারী প্রথা বাতিল করে সরকার পিআইসির হাতে তুলে দেয় হাওর রক্ষা বাঁধ কাজের ক্ষমতা। হাওরে পিআইসি বরাতে কাজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দুর্নীতি কি থেমেছে? গেল বছরের অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজরাই কোনো না কোনোভাবে পিআইসি পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে চালিয়েছে দুর্নীতি মহরত।

এবারও বাঁধ রক্ষা কাজে হরিলুট হওয়ার আশঙ্কা প্রবল আকার ধারণ করেছে। হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন হাওর রক্ষা বাঁধে দুর্নীতির ধূর্ত খেলা পরিলক্ষিত হয়েছে। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সুনামগঞ্জের হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে রীতিমতো হরিলুট শুরু হয়েছে। প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণ, কম দরে মাটি কেটে বেশি দরে বিল উপস্থাপনসহ ধাপে ধাপে চুরি ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। কাজের শিডিউলে ঘাস লাগানো ও মাটির স্থায়িত্ব (কম্পেকশন) মজবুত করার জন্য আলাদা টাকা দেওয়া হলেও সেটি করা হয়নি। ১৭৭ কোটি টাকার কাজে ইতোমধ্যে দুই কিস্তিতে ৬৬টি কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এতেই বাঁধের কাজ শেষপর্যায়ে। এখন বাকি ১১১ কোটি টাকার বিল তুলে নিয়ে পকেটস্থ করার তোড়জোড় চলছে। সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে এসব চিত্রই বেরিয়ে এসেছে। হাওর এলাকার বিভিন্ন বাঁধ পরিদর্শন, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, প্রশাসন, পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এলাকার বিশিষ্টজনরা ধারণা করছেন, এ বাঁধ নির্মাণে প্রস্তাবিত (১৭৭ কোটি টাকা) চারভাগের তিনভাগ টাকা আত্মসাতের ফাঁদ পাতা হয়েছে।’ অনুসন্ধানী এ সংবাদের ভাষা বলছে, দুর্নীতি কোনোভাবেই কমেনি বরং বেড়েছে। খবরের আরেকটি অনুচ্ছেদে বলা হয়, দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আলতাব উদ্দিন বলেন, ‘পিআইসিদের তালিকায় সভাপতি/সম্পাদক পদে বিভিন্ন নাম থাকলেও এর পেছনে আছে শক্তিশালী গডফাদার। নামে পিআইসি চেয়ারম্যান করা হলেও টাকা উত্তোলনের ব্যাংক চেকে স্বাক্ষর করেন আড়ালে থাকা সেই গডফাদাররা। এরা এবারও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। বিষয়টি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন চূড়ান্ত বিল পরিশোধ না করা হয়।’

হাওর রক্ষা বাঁধের পরিচ্ছন্ন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির দানবীয় হানা কি ঠেকাতে পেরেছে সরকার? দুর্নীতির হাত কতটুকু বেঁধে রাখতে পেরেছে সরকার জানা নেই, তবে এ বছর কঠোর নির্দেশনা ও তদারকিতে অল্প ত্রুটি-বিচ্যুতি বাদ দিলে হাওর রক্ষা বাঁধ অন্যান্য বছরের তুলনায় যথেষ্ট ভালো হয়েছে, সেটা প্রায় নিশ্চিত। এখন সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজন বাঁধ বরাদ্দে ছাড় না দেওয়া অর্থের প্রয়োগ যথেষ্ট যাচাই-বাছাই ও বাঁধের কাজ পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বশীল অঙ্গকে আরো তৎপর হতে হবে। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে হাওরে গ্রহণ করতে হবে দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ। নদী খনন ও দীর্ঘ টেকসই বাঁধ নির্মাণসহ হাওর এবং হাওরবাসীর উন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও কল্যাণমূলক কাজে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। কারণ প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে নামমাত্র কাজ সমাপ্তির মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ চক্রকে যেভাবে ফুলেফেঁপে কলাগাছ হওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তাতে সরকার ও হাওরবাসী তেমন উপকৃত হচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং সরকারকে বছরে বছরে বরাদ্দ না দিয়ে হাওরে দীর্ঘস্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করতে হবে। এখানেই হয়তো হাওরের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist