এস এম মুকুল

  ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

ব্লু-ইকোনমি

সমুদ্র সম্পদে সম্ভাবনা

সাগরের অজস্র জলরাশি ও এর তলদেশের বিশাল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের স্বপ্নপূরণে ও অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে পারে বাংলাদেশ। বিশাল এলাকা নিয়ে সমুদ্র জয়ের পর এবার সে বিপ্লব বাস্তবায়নের রোডম্যাপে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সমুদ্র সম্পদের প্রতি নজর দিয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ কাজে লাগাতে পারলে ঘুরে যাবে দেশের অর্থনীতির চাকা। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে ১৩টি জায়গায় আছে সোনার চেয়ে অধিক মূল্যবান বালি, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম। যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইট। অগভীরে জমে আছে ‘ক্লে’, যা দিয়ে তৈরি হয় সিমেন্ট। ধারণা করা হচ্ছে, এর পরিমাণ হিমালয়কেও হার মানায়। এই ক্লে উত্তোলন সম্ভব হলে সিমেন্ট কারখানাগুলো আরো বাণিজ্যিকভাবে শক্তিশালী হবে। এ ছাড়া তেল-গ্যাসের সন্ধানও মিলেছে সমুদ্রের তলদেশে। সবমিলিয়ে অমিত সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে যেন ডাকছে সমুদ্র সম্পদের সম্ভাবনা।

বাংলাদেশের সমুদ্র-তীরবর্তী তিন কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা আসে মৎস্য আহরণের মাধ্যমে। গভীর সমুদ্রের ন্যায্য অধিকার পাওয়ায় মৎস্য আহরণের বিপুল সম্ভাবনাও দেখছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে, এ অঞ্চলের টুনা মাছ সারা বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। সুস্বাদু ও দামি এ মাছটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের হোটেলগুলোয় আমদানি করা হয়ে থাকে। টুনা মাছের বিচরণ গভীর সমুদ্রে। মালিকানা অধিকারে বাংলাদেশের ফিশিং ট্রলার এখন গভীর সমুদ্রে টুনাসহ অন্যান্য মাছ আহরণের সুযোগ পাচ্ছে। মৎস্য আহরণের পাশাপাশি সমুদ্রের তীরবর্তী পর্যটনকেন্দ্রের মাধ্যমেও অর্থনৈতিক বিপ্লবের কথা বাংলাদেশ ভাবছে। জানা গেছে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সমুদ্রনির্ভর। বাংলাদেশের আমদানি-রফতানির ৯০ শতাংশই সম্পাদিত হয় সমুদ্রপথে। তা ছাড়া, বাংলাদেশেরর চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর দিয়ে প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ২ হাজার ৬০০ জাহাজের মাধ্যমে ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি-রফতানি হয়। এসব জাহাজ থেকে ভাড়া বাবদ আয় হয় ছয় বিলিয়ন ডলার। এসব জাহাজের অধিকাংশই বিদেশি মালিকানাধীন। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, বঙ্গোপসারের নিচে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুদ রয়েছে, যা আগামী দিনের জ্বালানি-রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ কারণে এ অঞ্চলটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ার অন্যতম জ্বালানি শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান করছে। পরবর্তী প্রাকৃতিক গ্যাসের সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। আশার খবর হচ্ছেÑশুধু গ্যাসই নয়, বঙ্গোপসাগরে ভারী খনিজের সন্ধান পাওয়া গেছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটাতে তাকিয়ে আছে সমুদ্র সম্পদের দিকে। ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। গবেষকরা বলছেন, বিপুল এই জনগোষ্ঠীর খাবার জোগান দিতে তখন সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে। আর এ কারণেই ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতিকে গুরুত্বারোপ করার তাগাদা দিচ্ছেন গবেষক ও বিশ্লেষকরা। বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রকি মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। সমুদ্রের বুকে প্রাপ্ত অনবায়নযোগ্য সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ্য তেল-গ্যাসসহ নানাবিধ খনিজ পদার্থ, যেমনÑ প্লেসার ডিপোজিট, ফসফরাইট ডিপোজিট, পলিমেটালিক ডিপোজিট, সালফাইড, ম্যাগানিজ নডিউলস ও ক্রাস্ট, গ্যাস হাইড্রেট, এভাপোরাইট ইত্যাদি। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে প্রকাশ, প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ন্যূনতম ১.৭৪ মিলিয়ন টন খনিজ বালুর সমাহার রয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে। এখানে মোট ১৭ প্রকারের খনিজ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে।

প্রতি বছর ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকা- সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগই সমুদ্রনির্ভর। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যে তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান জাতীয় বাজেটের দশ গুণ হবে। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্র সম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি আয় করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখানো হয়েছে, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে সমুদ্রনির্ভর ওষুধশিল্পও গড়ে তোলা সম্ভব। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, কেবল সমুদ্র অর্থনীতির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেই যথেষ্ট আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। সমুদ্র ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। সাগর থেকে প্রাপ্ত বায়ু, তরঙ্গ ঢেউ, জোয়ার-ভাঁটা, জৈব-তাপীয় পরিবর্তন এবং লবণাক্তের মাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক পরিমাণে নবায়নযোগ্য শক্তির জোগান পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রতি বছর পৃথিবীতে সমুদ্রবর্তী বায়ু ব্যবহারের সক্ষমতা ৪০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশকে যদি চীন বা তার মতো বৃহৎ অর্থনীতি থেকে উপকৃত হতে হয়, তাহলে আমাদের চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর আধুনিকায়ন করে এগুলোকে গমন-পথ হিসেবে ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর হলেও বিনিয়োগ ও দক্ষতার অভাবে এ সম্পদের সামান্যই অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এ খাতের বিস্তৃত সম্পদ অর্থনীতিতে যোগ করতে দরকার আরো দক্ষ জনশক্তি ও বিনিয়োগ। সরকার, বেসরকারি খাত ও গবেষকদের সম্মিলিত উদ্যোগে তা করা গেলে দেশের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। সেই সঙ্গে সমুদ্র সম্পদে সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ।

২০১৯ সালের মধ্যেই সমুদ্র অর্থনীতিতে বিপ্লব আনতে চায় বাংলাদেশ সরকার। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে সমুদ্র অর্থনীতি ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখছে দেশ। সাগরের সম্পদ আহরণে একদিকে নেওয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কর্মপন্থা। অন্যদিকে উপকূলীয় দেশগুলোর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেতে আগে থেকেই নেওয়া হয়েছে কার্যকর পরিকল্পনা। সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কার্যক্রম পরিচালনায় স্থায়ী একটি ব্লু-ইকোনমি সেল গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমুদ্রে অনুসন্ধান চালাতে শিগগিরই একটি জাহাজ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমুদ্র অর্থনীতিতে বিনিয়োগের নতুন দিগন্তে এখন বাংলাদেশ। বিশ্বের সম্পদশালী রাষ্ট্রগুলোও বাংলাদেশের ব্লু-ওসান ইকোনমি বা নীল সমুদ্র অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী। বঙ্গোপসাগরের অফুরান সম্পদ কাক্সিক্ষত পরিমাণে আহরণ সম্ভব হলে ১০ বছরের মাথায় বাংলাদেশের অর্থনীতি অভাবনীয় উচ্চতায় পৌঁছাবে। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, এর মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিধি বাড়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন অনেক গুণ বেড়ে যাবে। পাশের দেশ মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে বড় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলাও হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্লু-ইকোনমি বা নীল সমুদ্রের অর্থনীতির এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদ বদলে দেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্নপূরণে সমুদ্র সম্পদনির্ভর নীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা ও সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। সামুদ্রিক এলাকায় প্রধানত খনিজ সম্পদ রয়েছে। বালিতে এক রকম। আবার পানির গভীরে আরেক রকম। পানির গভীরে গ্যাস সম্পদ আছে। শুধু মাছই রয়েছে প্রায় ৫০০ প্রজাতির। এ ছাড়া রয়েছে শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া, অক্টোপাস, হাঙ্গরসহ বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী। এগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থকরী ফসল হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির আকার প্রায় ৮৮ ট্রিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সমুদ্র অর্থনীতির আকার ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের তথ্য মতে, গভীর সমুদ্রের বিশাল অংশ বাংলাদেশের জলসীমায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর পরিমাণ দেশের মোট স্থল অঞ্চলের প্রায় ৮১ শতাংশ। প্রায় ৭৫টির মতো ছোট-বড় দ্বীপ রয়েছে। এগুলোয় পর্যটন সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। বেসরকারি সংস্থা ‘সেভ আওয়ার সি’র এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পণ্য আমদানি-রফতানিতে বাংলাদেশি জাহাজ যুক্ত হওয়ায় এ খাতে নতুন ধরনের কর্মসংস্থান বাড়ছে। বর্তমানে ২৫০ জাতের মিঠাপানির মাছের বিপরীতে সাগরে রয়েছে অন্তত ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর আট মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা আহরণ করে। নীলপানির নিচে লুকিয়ে থাকা এসব সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতি। আমরাও নতুন সদস্য হিসেবে স্থান করে নিতে পারি উন্নত বিশ্বে।

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist