শামীম শিকদার
মতামত
বেকারত্ব বৃদ্ধির নেপথ্যে
পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পাওয়া অনেকটা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ, দেশে যেভাবে শিক্ষিত বেকাররে সংখ্যা বাড়ছে, তাতে এমনটি মনে করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রত্যেকটি পরবিার থেকে তাদের সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন দেখে। মনের ভিতরে এক ধরনের আশা নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ বহন করে থাকে। কিন্তু যখন বিশ্ববদ্যিালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়ার পরও প্রত্যাশা অনুয়ায়ী যকন কোনো চাকরির সুযোগ পায় না, তখন বেকারদের পাশাপাশি হতাশায় ভোগে তাদের পরিবার। নিজের মনের ভিতর হতাশা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি ধীরে ধীরে পরিবারের চোখে বোঝা হতে শুরু করে। সব জায়গায় নিজের অস্তিত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে হতে হয় হাসির পাত্র। অনেকে নিজেকে আগাছা ভেবে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। সম্প্রতি ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন তিন লাখ ৪৬ হাজার ৫৩২ জন। ৩৭তম বসিএিসের প্রিলিমিনারিতে পরীক্ষা দিয়েছিলেন দুই লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৬ জন। বর্তমানে সরকারি অফিস, মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরসমূহে শূন্যপদের সংখ্যা তিন লাখ ৫৯ হাজার ২৬১। একদিকে পদ শূন্য থাকা, অন্যদেিক বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও চাকরি না পাওয়া খুবই দুঃখজনক। সরকারি হিসাবে বাংলাদশেরে তরুণ বেকারের হার সবচেয়ে বেশি; যা ১০ দশমকি ৪ ভাগ। তাদের মধ্যে নারীদের হার ১৫ শতাংশবেশি। দেশের কর্মক্ষম নারীদের ৬ দশমিক ৮ ভাগ বেকার, পুরুষের মধ্যে ৩ শতাংশ বেকার।
এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা বেকারদের ৫৬ শতাংশ ছয় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় পর্যন্ত কাজ পাননি। কমপক্ষে ছয় মাস বেকার থাকে ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ লোক। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষিতদের ৪৭ শতাংশ ছয় মাস থেকে দুই বছররে বেশি বেকার থাকে। কমপক্ষে ছয় মাস বেকার থাকে ৪৫ শতাংশ লোক। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষিতদের অর্ধেকই থাকে ছয় মাস বেকার। ৩৫ শতাংশ লোক ছয় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় পর্যন্ত বেকার থাকে। অন্য এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশের জনশক্তি প্রয়োজনের তুলনায় তেমন দক্ষ না হওয়াতে অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে; যাদের জন্য বছরে ব্যয় হচ্ছে তিন থেকে পাঁচ বলিয়িন ডলার। বিসিএসের হিসাবে ১৫ বছরের ওপরে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ছয় কোটি সাত লাখ। এ শ্রমশক্তির মধ্যে পাঁচ কোটি ৮০ লাখ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু কোনো মজুরি পান না, এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১১ লাখ। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বের হয়ে পাচ্ছেন না চাকরি। অন্যদিকে বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে প্রতারক চক্র চাকরি দেওয়ার নাম করে ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ব্যবসায়ী উদ্যোক্তরা বভিন্নি সাক্ষাৎকারে শিক্ষিত বেকার সংখ্যা বাড়ার পেছনে তাদের শিক্ষাকে দায়ী করছেন। যেমন রাষ্ট্রবজ্ঞিান ও ইসলামের ইতিহাসের মতো অনেক বিষয় থেকে অনেকে পাস করছেন কিন্তু বাজারে তাদের চাহিদা নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থাও অনেকটা দায়ী। কারণ, প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসে একেকটি শিক্ষানীতি করে, কিন্তু দেশের ভেতরে বা বাইরে কী ধরনের শিক্ষার কতটুকু চাহিদা, তা নিরূপণ করে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কাজটি কেউ করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে, কিন্তু এসব বিভাগের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে না।
অন্যদিকে বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে অনেক ভুয়া চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। দেয়ালে লিফলেট টাঙিয়ে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করছে জনশক্তি। কিন্তু নিয়োগের নাম করে বিভিন্ন কায়দায় তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। অনেকে বাধ্য হয়ে প্রত্যাশার বাহিরে করছে চাকরি। বেকারত্বে অসারতা দূর করতে অনেকে নাম লেখাচ্ছে বখাটের খাতায়। সারাদিন কোনো কাজ না থাকায় সময় ব্যয় করার জন্য বভিন্নি স্থানে ঘোরাঘুরি করে নানান ধরনের অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়। বেকারত্ব বাড়ার পেছনে অনেকেই অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে দায়ী করছে। কারণ সনদপত্র অর্জন করা অনেক শিক্ষিত লোক আছেন যাদের মাঝে ন্যূনতম জ্ঞানবোধ নেই। আবার অনেকে রয়েছেন শুধু সনদপত্র অর্জনের দলে। যাদের মূল উদ্দশ্যে হচ্ছে প্রতিষ্ঠান থেকে একটি সনদপত্র অর্জন করা, যাতে করে গ্রামের বা প্রতিবেশীরা অশিক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। বর্তমানে সনদপত্র অর্জন করে চাকরির জন্য কোনোভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা যায় না তার জন্য প্রয়োজন হয় কারিগরি শিক্ষার। কোনো প্রতিষ্ঠানে একজন ম্যানেজারকে অফিসিয়াল কাজ করার পাশাপাশি কম্পিউটার ও ব্যাংকিং সাইডে কাজ করতে হয় তাই ম্যানেজার নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু সনদপত্র অর্জন নয় যিনি সব দিকে সমান জ্ঞান রাখেন তাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া। বেকারত্ব রোধে সবার প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সচেতন থাকতে হবে। সনদপত্র প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পড়ালেখার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার দিকে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ভুয়া চাকরিদান প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে তাদের বিরদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে সনদপত্রকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রকৃত মেধাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
"