অলোক আচার্য্য

  ২৭ এপ্রিল, ২০১৮

আলোকপাত

কোথায় সেই গ্রামীণ সংস্কৃতি

আধুনিক জীবনযাপনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া আমাদের তেমন কোনো উপায়ও নেই। যুগের চাকা এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে আমরা নিজেদের বিশ^াস, কাজ ও সামর্থ্যের ওপর থেকেও বিশ^াস হারিয়ে ফেলছি। একসময় যখন ক্যালকুলেটরের তেমন প্রচলন ছিল না, তখন হিসাব করার জন্য নিজেদের মগজ ব্যাবহার করতে হয়েছে এবং তখন হিসাব করতে সময় লাগলেও সহজ সহজ হিসাব খুব সহজ ও দ্রুত সময়ে করতে পারতাম। কিন্তু যখন ক্যালকুলেটরের বহুল ব্যবহার শুরু হলো, তখন থেকেই সহজ সহজ হিসাবগুলোও যন্ত্রের সাহায্যে করতে শুরু করলাম। এতে হিসাবটা নির্ভুল ও দ্রুত সময়ে অবশ্যই হয়েছে কিন্তু আজ যখন দেখি খুব সহজ হিসাব করার জন্যও আমাদের ছেলেমেয়েরা ক্যালকুলেটর ব্যাবহার করছে তখন মনে হয় প্রযুক্তি আমাদের কতটা অলস করে দিচ্ছে। পরিশ্রম করতে আমরা আর একদমই রাজি নই। প্রযুক্তি আজ আমাদের বিরক্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই গভীর রাতে মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলে, বিরক্তির জন্ম দেয়। এতে অনেকসময় সেটা ছুড়ে ফেলতেও ইচ্ছা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়া নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তিত থাকতে হয়।

একসময় আমাদের জীবনযাপন এতটা ব্যস্ত আর বিরক্তিকর প্রযক্তি নির্ভর ছিল না। সেই গ্রামীণ সহজ-সরল সাদামাটা জীবনযাপনের দিনগুলোতে ফিরে দেখলে দেখা যায়, সেদিনগুলো ছিল নির্মল আনন্দের দিন। প্রযুক্তির দাপট এতটা ছিল না। এদেশের প্রতিটি গ্রামের চিত্র ছিল প্রায় এক রকমের। কোলাহলমুক্ত, পাখির কলতানে ভরা, নদীর সঙ্গে গভীর মিতালীÑ এসবই ছিল সাধারণ চিত্র। মাঠে তাকালেই ছেলেমেয়েদের গ্রামীণ সব খেলাধুলার ছবি চোখে পড়ত। কত খেলার নাম আজ আর মনে নেই। কত খেলা কত নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে খেলা হতো। গ্রামীণ খেলাধুলা যেসব ছিল সেসবে ছিল না কোনো কৃত্রিমতা। তার পরিবর্তে ছিল নিখাদ বিনোদন। জয়-পরাজয় আজকের মতোই ছিল কিন্তু কোনো অংকের হিসেব ছিল না। কিছু কমন খেলা ছিলÑ দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, গোল্লাছুট, ঘুড়ি ওড়ানো, গোশতো চুরি, বৌছি, আতা-পাতা, ইচিং-বিচিং এরকম আরো অনেক অনেক খেলায় মেতে থাকত শিশু-কিশোররা। প্রযুক্তি ছাড়াই এসব খেলায় মেতে উঠত তারা। এই সময় আরো একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় ছিলÑ সেসময় ছেলেরা এবং মেয়েরা মিলেমিশে খেলাধুলা করত এবং তা অনেকটা বড় হয়েও; আজ যা ভাবা যায় না। সেসময় সেটাই স্বাভাবিক ছিল। আজকের অনেকেই যারা গ্রামে বড় হয়েছেন, তারা বিষয়টি জানেন। অর্থাৎ মনে নেতিবাচক চিন্তা-চেতনার কোনো সুযোগই ছিল না। আমরা ছেলেমেয়ের দল প্রতিদিন দল বেঁধে নদীতে দাপাদাপি করতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এটাও যে তখন খেলার একটা অংশই ছিল। এসব খেলাধুলা সম্পর্কে আজ আর শহরের ছেলেমেয়েরা জানে না, বোঝেও না। আগ্রহও নেই। কারণ, খেলা আজকাল ঘরের ভেতরেই হয়। মোবাইলে বা ট্যাবে বা কম্পিউটারে।

দুর্দান্ত সব গেমসে ঠাসা থাকে কম্পিউটারটি। সেসব কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে থাকে উত্তেজনাকর সব খেলা। রীতিমত দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়। অবশ্য গ্রাম থাকলে তো গ্রামের খেলাধুলা বেঁচে থাকবে। আজকাল তো গ্রামগুলো শহরের মতো হয়ে গেছে। গ্রামের মানুষগুলোর সেই সারল্যও আজ কাঠিন্যতে আটকে আছে। প্রতিটি কথা, প্রতিটি পদক্ষেপে কেবল লাভ-ক্ষতির হিসাব। তাই গ্রামীণ খেলাধুলা না থাকলেও তাতে ক্ষতি নেই! কিন্তু এসব বিসর্জন দিয়ে আমরা নিজেদের সাহেবের কাতারে দাঁড় করিয়েছি ঠিকই সেই সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে গেছি। কানামাছি, বৌছির বদলে আজ ক্রিকেট, ফুটবল বরং বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে পাশ্চাত্যের ক্রিকেট খেলা আামদের সব খেলা ভুলিয়ে দিয়েছে। সাহেবদের খেলার আজ বিশ^জোড়া জয়জয়কার। আইপিএল, বিপিএল, পিসিএল আর কাউন্টি ক্রিকেটের কথা মুখে মুখে। সেসব খেলায় গ্রামে গঞ্জেও আজ বাজি হয় লাখ টাকা। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমাদের গ্রামীণ খেলার মধ্যে এতটা উত্তেজনা থাকত না। থাকত কেবল আনন্দ। কারণ, পয়সা খোয়ানোর চিন্তা তো থাকত না। তাই আজ সেই গ্রামীণ খেলাগুলোকে মনে পরে। মনে পড়ে হারাতে বসা সেই চিরায়ত দৃশ্যগুলোকে।

গ্রামীণ খেলাধুলা যেমন আমাদের আনন্দের জোগান দিত ঠিক সেরকমভাবে গ্রামের বিনোদনের মাধ্যমও ছিল ভিন্ন। তখন ঘরে ঘরে এত টেলিভিশন এত স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল না। তার গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর এসবের প্রতি এতটা আগ্রহও ছিল না। কারণ তখন বিনোদনের আগ্রহ ছিল অন্য জায়গায়। গ্রামের মানুষের কাছে বিনোদনের উৎস বলতে ছিল যাত্রাপালা। কোনো গ্রামে যাত্রাপালা বছরে একবার একেবারে ঘটা করে উৎসবের আমেজে অনুষ্ঠিত হতো। মাস ধরে যাত্রার অভিনয়ের রিহার্সেল দিত। পুরো গ্রামে সাজ সাজ রব পরে যেত। নারী পুরুষের ভেতর চাঞ্চল্য বিরাজ করত। এখন যেমন রিমোট দিয়ে একের পর এক চ্যানেল ঘুরেও অনেক সময় দেখার মতো কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না তখন এমনটা ছিল না। আসলে আমরা নিজের অজান্তেই নিজেদের এই আধুনিকতায় বিরক্ত। যাত্রা ছাড়াও ছিল পালাগান, কুস্তির লড়াই, বায়োস্কপ। বিনোদন বলতে তখন এসবকেই বোঝানো হতো। এসব গ্রামে গঞ্জে সেসময় এক পরিবারের সঙ্গে অন্য পরিবারের এমনকি গ্রামের প্রায় সব পরিবারের সঙ্গেই যোগাযোগ থাকত। খুব সহজেই অন্যের সুখ বা দুঃখের খবর জানা যেত। বিকেল হলেই গ্রাম্যবধূরা জড়ো হতো গল্পগুজব করে সময় কাটাত। আজ এত সময় নেই গল্প করার। আজ বাড়ির পাশের জনকেও না চিনে বছরের পর বছর পার করি। সমগ্র সভ্যতায় আজ এক অদ্ভুত একাকীত্ব ভর করেছে। এসব কি যান্ত্রিকতার ফল নাকি আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার ফল?

গ্রামীণ খেলাধুলা ও গ্রামীণ সংস্কৃতি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এখনো সুদূর কোন গ্রামে হয়তো এসব খেলা ও সংস্কৃতির চর্চা হয়। তবে যেভাবে এসব হারাতে বসেছে তাতে আর কত বছর এসবের অস্তিত্ব টিকে থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমরা যতই আধুনিক যুগে প্রবেশ করছি ততই আমরা নিজেদের স্বকীয়তাকে অস্বীকার করছি। যেসব খেলাধুলা আজ আমাদের বর্তমান প্রজন্ম খেলছে সেসব খেলা তাদের মানসিক শান্তির পরিবর্তে মনকে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তারা একরোখা, চিন্তাযুক্ত, বদমেজাজি এবং একাকিত্বে ভুগছে। সাময়িক প্রশান্তিতে এসব খেলায় অংশ নিয়ে তারা নিজেদের ক্ষতি করছে। অন্যদিকে আমাদের নিজস্ব খেলাগুলো আমাদের আধুনিক সভ্যতার ভেলকিবাজিতে হারিয়ে যেতে বসেছে। সেই সঙ্গে গ্রামীণ সংস্কৃতিও।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist