এস এম মুকুল

  ২৬ এপ্রিল, ২০১৮

বিশ্লেষণ

উন্নয়নের অন্তরায় ও উত্তরণ

আইন না মানার প্রবণতা : সমাজের এই চিত্র ভয়ংকর অস্বাভাবিকতায় রূপ নিচ্ছে। মানুষের ভেতর সহমর্মিতা, ভালোবাসা, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, স্নেহপরায়ণতা অনেক কমে গেছে। অন্যপক্ষে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সহানুভূতির জায়গাগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে-অসহিষ্ণুতার মনোভাব প্রকট হয়ে উঠছে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে। আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা না থাকা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থার সংকট এই পরিস্থিতিকে উসকে দিচ্ছে। পরিত্রাণের জন্য দরকার সরকারের নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সমাজবিশ্লেষকদের অভিমত, ছোট অপরাধের জন্য বড় শাস্তির ব্যবস্থা কার্যকর হলে সমাজ থেকে অপরাধপ্রবণতা ৭৫ ভাগ কমে আসবে। যেমন আইন মানতে বাধ্য করা, অপরাধপ্রমাণিত হওয়া মাত্র শাস্তি দেওয়া, ভেজাল-ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম-দায়িত্বে অবহেলা, প্রতারণা-দখল-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ইত্যাদির ক্ষেত্রে অপরাধ যত ছোটপর্যায়ের হোক না কেন, শাস্তি আর জরিমানা বেশি হলে এমন প্রবণতা কমতে পারে। খাদ্যে ভেজাল, খাদ্য মজুদ, ট্রাফিক আইন না মানা, পথচারীর ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করা এমনসব অপরাধের জন্য জেল এবং জরিমানা উভয়দ- কার্যকর হওয়া উচিত। এমনসব অপরাধীর শাস্তির খবরও ফলাও প্রচার করা দরকার। উন্নত বিশ্বে সরকারের নিয়ম অমান্য করলেই অপরাধ হিসেবে তৎক্ষণাৎ শাস্তি দেওয়া হয় বলে সেসব দেশে রাস্তায় কেউ কলার ছোলা বা চিপসের প্যাকেট ফেলার কথা ভাবতেও পারে না। বাংলাদেশে সময় লাগলেও এমন আইন মান্যতার প্রবণতা সৃষ্টি করা অসম্ভব নয়। তবে এজন্য জনসংখ্যার অনুপাতেÑপুলিশ বাহিনীর বিভাগ ও কলেবর বাড়ানো দরকার আছে বলে সর্বসাধারণের ধারণা।

অবহেলায় গ্রন্থাগার : মেধাবী ও মানবীয় সমাজ, সুনাগরিক গঠন সর্বোপরী সুশীল জাতিগঠনে খুবই হতাশাজনক খবর এটি। উন্নয়নের জোয়ারের পাশাপাশি জাতির জ্ঞান বিকাশে এ অবহেলা কাম্য নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এ কথাটি সত্যি হলেও দেশে আদর্শিক শিক্ষার পরিশীলন, মূল্যবোধের চর্চা, চেতনার স্ফুরণ ঘটাতে গ্রন্থাগার বা পাঠাগারের প্রতি এই অমনোযোগ সুষম উন্নয়ন ধারাকে টেকসই হতে বাধার সৃষ্টি করবে। বর্তমান সরকার সামাজিক উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে নানান মেয়াদি প্রকল্প চালু করছেন। অথচ জ্ঞাননির্ভর মেধাবী প্রজন্মের জন্য, সমাজ তথা রাষ্ট্রের মানবীয় বিকাশে দেশের গ্রন্থাগারগুলোর জন্য বিশেষ বরাদ্দ নেই কেন-এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে। আমরা জানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইপ্রেমী মানুষ। তিনি একটি চেতনাশীল জাতিগঠনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। তিনি নিশ্চয়ই দেশের গ্রন্থাগারগুলোকে আধুনিকীকরণে যথেষ্ট বরাদ্দ দিয়ে সংস্কার ও উন্নয়নের নির্দেশনা দেবেন। বলা প্রয়োজন, সৃজন ও মননশীল জাতি গঠনে গ্রন্থাগার উন্নয়ন এবং বৃদ্ধীকরণের বিকল্প নেই। দেশের প্রত্যেকটি উপজেলা পর্যায়ে সরকারি গ্রন্থাগার স্থাপন করা আবশ্যক। চলতি গ্রন্থাগারগুলোয় জনবল বাড়ানো দরকার। প্রযুক্তির ব্যবহার, সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের জন্য সোলার ব্যবস্থা, নিরাপদ সুপেয় পানি, কফি কর্নার, স্বাস্থ্যসম্মত বাথরুম সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্যাম্পাস গ্রন্থাগার চালু করা এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই নীতি বাধ্যতামূলক করা দরকার। সরকার গ্রন্থাগারগুলোয় বছরে ২০০ কোটি টাকার বই দিলে দেশের প্রকাশনা শিল্পও ঘুরে দাঁড়াবে। দেশে অনেক লেখক, গবেষকসহ সংশ্লিষ্ট পেশাদার তৈরি হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম স্কুল থেকে বইপ্রেমী হয়ে উঠলে তবেই না আমরা মননশীল জাতি উপহার পাব।

ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা : মুনাফালোভী বণিকদের অর্থলিপ্সার কাছে আর কত প্রতারিত হবে সাধারণ জনগণ। জিনিসের দাম বাড়ে, তবে পণ্যের মান কমে কেন। পরিমাণ ও আকারে ছোট হয় কেন। এসব দেখার দায়িত্ব যেসব নিয়ন্ত্রক সংস্থার, তাদের জনবল কবে বাড়বে। জনগণকে সচেতন করার দায় কি তারা এড়াতে পারেন? এসব প্রতারণা বন্ধে নিয়মিত অভিযান মোটা অঙ্কের জরিমানা এবং তৎক্ষণাৎ কঠোর আইনি শাস্তির প্রয়োগ খুব জরুরি।

হাওরে বিপর্যয় : হাওরের বিপর্যয় গত বছরের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। প্রতি বছর হাওরের ফসলহানির আশঙ্কা দেখা দেয়। হাওর রক্ষা বাঁধগুলো কেন স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয় না। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওর এলাকার উন্নয়নে নির্দেশনা দেওয়ার পরও সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে কাজগুলো হচ্ছে না। আমরা জানি প্রধানমন্ত্রীর সাহসিকতা আর উদ্যোগে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা ঘুঁচে গেছে। আমাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় হাওরবাসীর অকালবন্যায় ফসলহানির অনিশ্চয়তাও ঘোঁচানো সম্ভব। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় ফসলের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা, ক্ষতির কারণ এবং দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা, হাওরের উপযোগী কম সময়ে উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনে কৃষিবিজ্ঞানীদের দিকনির্দেশনা দেওয়া, হাওরের নদী ও খালগুলো খনন করা, দ্রুততার সঙ্গে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তত্ত্বাবধানে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করা, অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে হাওরে বীজ বোনার জন্য বীজ সহায়তা ও কৃষির খরচ মেটাতে ব্যাংকঋণ সহায়তা, কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, শুকনো মৌসুমে হাওরের পতিত জমিতে হাওরের মাটিতে ফলন উপযোগী সরিষা, মাসকলাই, মসুর, ভুট্টা, গম, শীতকালীন সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করা, বর্ষায় আখ চাষ-ভাসমান সবজি চাষ, কুটিরশিল্প, গরু-ছাগল (ব্ল্যাকবেঙ্গল)-মহিষ পালন, হাঁস ও মুরগির খামার প্রভৃতি প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিলে হাওরের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব ও টেকসই হবে।

অর্থ পাচারে অনাচার : অর্থ কেন পাচার হয় সে কারণটি আগে খুঁজে বের করতে হবে। ১০ বছরে যে পরিমাণ টাকা পাচারের মাধ্যমে গেছে, তা দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসতে পারত মধ্য আয়ের দেশ থেকে খুব বেশি অপেক্ষার দরকার পড়ত না। অদ্ভুত লাগে, কালোটাকা বলে যে টাকাকে দেশের মাটিতে সহজে বিনিয়োগ করতে দেওয়া হচ্ছে না, সে টাকাই পাচার হয়ে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোম বানাচ্ছেন বাঙালিরা! মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যদি দুর্নীতি বা কালোটাকাকে সাদা করার ক্ষেত্রে তাদের দেশে বাণিজ্যের সহজ সুযোগ করে দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন ১০ বছরের জন্য বিনা বাধায় রেলওয়ে, পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন ও জেলা পর্যায়ে বাণিজ্য বিকাশে সুযোগ করে দিতে পারবে না, সেটাই বোধগম্য নয়। কালো হোক ভালো হোক-দেশের টাকা দেশের মাটিতে গড়াগড়ি খেলেও দেশ ও জনগণের লাভ হবে। টাকা বিদেশে পাচার হলেই বরং ক্ষতি। সরকারের দরকার উন্নয়নের চাকা ঘুরাতে দেশে শিল্প বিকাশে এসব টাকা অবশ্যই নির্দিষ্ট মেয়াদে সহজে বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া। তবে কালোটাকা উপার্জনের পথও বন্ধ করা দরকার। এ জন্য এনবিআর, দুদক নামের প্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিকীকরণ ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে সবার আগে।

লেখক : সাংবাদিক ও কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist