ইয়াসমীন রীমা

  ২৬ এপ্রিল, ২০১৮

পর্যালোচনা

রেজিস্ট্রেশনহীন বিয়ে

ইউনিয়ন পরিষদের অফিসের সালিসি শেষে মামাতো ভাই রজ্জুকে নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরেছিল ফেরদৌসী। পথে দেখা হয় গ্রামের স্কুলের দফতরি হাসেম মিয়ার সঙ্গে। হাসেম মিয়া তাকে সাšত্ম¦নার বাণী শোনালেও জাহানারা কিছুতেই নিজেকে শাšত্ম করতে পারছিল না। তার ধারণার বাইরে ছিল সরল বিশ্বাস মানুষকে এমন করে ঠকাতে পারে। পিতৃমাতৃহীন ফেরদৌসী দাদার মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। অসচ্ছল মামা যেটুকু পেরেছে, তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছে তার চাহিদা পূরণ করতে। মামার দায়ভারটা হ্রাস করতে নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করে পাশের গ্রামের রডমিস্ত্রি কবীরকে। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখেই ছিল জাহানারা। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সংসারে দুঃখের বাণ ঢুকে পড়ে। বড়মিস্ত্রি কবীর উপজেলা অফিসে কাজ করতে গিয়ে ঢালাই মেশিনম্যানের রূপসীকন্যা ছবির প্রেমে পড়ে যায় এবং তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রূতি দিয়ে এক সকালে তুচ্ছ একটি ঘটনার সূত্রপাত ধরে ফেরদৌসীকে তালাক দিয়ে তার ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়। তালাকের দশ দিনের মাথায় কবীর ছবিকে বিয়ে করে ঘরে তুলে আনে। রাগে-ক্ষোভে-লজ্জায় ঘৃণায় ফেরদৌসী দীর্ঘদিন নিজেকে একমাত্র আশ্রয়স্থল মামার বাড়িতে নিজেকে আড়াল করে রাখে। পরে গ্রামের পল্লী ডাক্তার কুদ্দুসের পরামর্শে সে তার ক্ষতিপূরণের দাবি জানায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যান সালিস ডাকে ঠিক, তবে বিয়ের কাবিন বা রেজিস্ট্রেশন না থাকায় ফেরদৌসীকে নিরাশ হতে হয় এবং কবীরের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অপ্রমাণিত হয়ে পড়ে এবং বঞ্চিত হয় কাবিনের দেনমোহর থেকে। বিয়ের সময় মৌখিক ৫০ হাজার টাকার একটি দেনমোহরের কথা উল্লেখ ছিল মাত্র। এখন ফেরদৌসীর এই পৃথিবীতে নিরাশার আঁধারে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া আর গšত্মব্য কী?

বিবাহ বা বিয়ে দুটিই বিশেষ্য পদ। যার অর্থ দার, পরিগ্রহ, পরিণয়, পানিগ্রহণ। মানুষের ইতিহাসের সূচনালগ্নেই ঠিক বিয়ের পদ্ধতি প্রচলিত ছিল না। বরং বিয়ের উৎপত্তি ও ইতিহাস বেশ আধুনিক এবং মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিশ্ববিখ্যাত নৃ-তত্ত্ববিদ ওয়েস্টারমার্কের মতে, পরিবার গঠন থেকে স্ত্রী-পুরুষের একত্রে বসবাস করা থেকেই বিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়। বিবাহ প্রথা থেকে পরিবারের সূচনা হয়নি। কমবেশি তিন হাজার বছর আগে মহাভারতে বলা হয়েছে, উপমহাদেশে শ্বেতকেতুই প্রথম বিয়ে প্রথার প্রবর্তন করেন। কিন্তু বিতর্কিত কাহিনিতে পরিষ্কার যে, তার আগে থেকেই শ্বেতকেতু বসবাস করতেন বাবা-মায়ের সঙ্গে। তবে বাখোপেন, মরগান ও অন্য নৃ-তত্ত্ববিদদের মতে, মানুষের আদিম অবস্থায় যৌনাচার নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো অনুশাসন ছিল না বরং অনুশাসনের উদ্ভব হয়েছে ধীরগতিতে। পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশেও রকমারি বিয়ের প্রচলন, সেসব রূপ লাভ করেছে বিবর্তনের মাধ্যমে। তবে মতামত যাই থাকুক না কেন, স্ত্রী-পুরূষ একত্রে মিলিত যে পরিবার গঠন করে সহবাস করার নীতি প্রায় গোড়া থেকেই ছিল মানুষের সমাজে।

মুসলিম আইন অনুসারে বিয়ে হচ্ছে ধর্ম কর্তৃক অনুমোদিত একটি দেওয়ানি চুক্তি। পাত্রীর পিতৃপক্ষের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা, পাত্রীর সৌন্দর্য গুণাবলি, বিচক্ষণতা অর্থাৎ যোগ্যতা বিবেচনা করে যে মোহর নির্ধারিত হয়, তা উপযুক্ত দেনমোহর নামে পরিচিত। অধিকন্তু মুসলিম বিয়ের বেলায় দেনমোহরের অর্থ ও আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে নির্ধারিত হয় দেনমোহর, যা কিনা স্বামী জীবদ্দশায় পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। তবে মুসলিম আইন অনুসারে দুই ধরনের দেনমোহরের পরিশোধের নিয়ম আছে। প্রথমটি হচ্ছে-নির্ধারিত দেনমোহর। দ্বিতীয়টি-উপযুক্ত দেনমোহর। বলাবহুল্য, নির্ধারিত দেনমোহর দুরকম-যে দেনমোহর বিয়ের প্রাক্কালে কিংবা চাওয়ামাত্র শোধ করা হয় তা তলবি দেনমোহর। আর তালাকপ্রাপ্ত বা স্বামী-স্ত্রীর কারো মৃত্যু ঘটলে যে দেনমোহর আদায়যোগ্য তা হলো স্থগিত বা বিলম্বিত দেনমোহর। দেনমোহরের অর্থপ্রাপ্তি স্ত্রীর অধিকার। যদিও সে তালাকপ্রাপ্ত হয় তবু। তাই বিয়ের প্রমাণপত্র হিসাবে প্রয়োজন রেজিস্ট্রেশনকৃত নিকাহনামা। আর এই রেজিস্ট্রেশনকৃত নিকাহনামা ছাড়া দেনমোহরের অর্থ আদায় করা সম্ভব নয়।

বিয়ে সম্পর্কিত অত্যাবশক তথ্যাবলি সরকারি রেজিস্ট্রারে লেখাই হচ্ছে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন। মুসলিম বিয়ে ও তালাক আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী প্রতিটি বিয়ের রেজিস্ট্রেশন জর¤œরি। মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে যেদিন বিয়ে সম্পাদিত হবে, সেদিনই নিকাহ রেজিস্ট্রার দ্বারা বিয়ের রেজিস্ট্রেশন একাšত্ম প্রয়োজন। সেদিনই যদি অবস্থার প্রতিকূলে করানো না হয়, তবে বিয়ের তিন সপ্তাহের মধ্যে করাতে হবে। রেজিস্ট্রেশনবিহীন বিয়ে এখনো কেন হচ্ছে এবং বিবাহ রেজিস্ট্রেশন গুর¤œত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেছেন, ‘আমাদের সমাজে অনেকে জেনেশুনে বাড়তি ঝামেলা ভেবে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করে না, আবার ২৫ শতাংশ এই বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞাত এবং অসচেতন।’

বাংলাদেশে মুসলিম বিয়ে ও তালাক আইন ১৯৭৪ অনুসারে প্রতিটি বিয়ের রেজিস্ট্রেশন আবশ্যক। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন না করা এই আইনের (৫২) ধারা অনুযায়ী দ-নীয় অপরাধ। এই অপরাধে তিন মাস পর্যšত্ম বিনাশ্রমে কারাভোগ বা ৫০০ টাকা পর্যšত্ম জরিমানা বা উভয় ধরনের শাত্নি রয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ে বিয়েটা পারিবারিক নিয়মে হয় এর কোনো রেজিস্ট্রেশন করার বিধান নেই। হিন্দু বিয়েটা সম্পূর্ণ একটি পবিত্র বন্ধন ও ধর্মীয় নির্দেশ। হিন্দুু সমাজে বিবাহ কোনো চুক্তিবিশেষ নয়। ১৯৫৫ সালে হিন্দু বিবাহ আইন প্রণীত হওয়ার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অন্যদিকে খ্রিস্টান সমাজে বিয়ে একটি চুক্তি বিশেষ এবং গির্জার পুরোহিতের নিকট যথাযথ নিয়ম ও প্রক্রিয়ায় ম্যারেজ সার্টিফিকেট বা নিকাহনামা সংগ্রহ করতে হয়। দেশের গ্রামাঞ্চলে গবেষণার জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্বামীরা স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার প্রথম উদ্যোক্তা এবং সম¯ত্ম তালাকের ঘটনার মধ্যে ৭৯ শতাংশ বিয়ের কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই।

১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ গৃহীত নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপক্ষসমূহ বিবাহ ও পারিবারিক সম্পর্কবিষয়ক সর্বক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণের সব উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকারি রেজিস্ট্রিতে বিবাহ রেজিস্ট্রেনভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করার জন্য আইনপ্রণয়নসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবে। রেজিস্ট্রেশনহীন বিয়ের কারণে একজন নারী, দেনমোহর ও ভরণপোষণ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্ত টাকা থেকে বঞ্চিত হয়, অস্বীকৃত হয় উত্তরাধিকারী থেকে, নিগৃহীত হয় সমাজ থেকে, সর্বোপরি পরিচিত হয় তার সšত্মান অবৈধ বলে।

তার পরও অবলীলায় রেজিস্ট্রেশনবিহীন বিয়ে হচ্ছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ বিবাহ রেজিস্ট্রেশন গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, এখনো দেশে প্রায় ৪০ শতাংশ বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করা হয় না। গ্রামের নারীর বিবাহিত জীবনে, বৈধব্য জীবনে অথবা তালাকপ্রাপ্ত পর্যায়ে সবচেয়ে নিরাপত্তাহীন করছে রেজিস্ট্রেশনহীন বিবাহ ও দেনমোহর থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা। কর্মজীবী নারী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার বলেছেন, ‘পারিবারিক পর্যায়ে নারী নির্যাতনের ঘটনার মুখ্য শিকার গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারীরা। রেজিস্ট্রশনবিহীন বিবাহ তাদের করছে খুব বেশি নিরাপত্তাহীন ও হতাশাগ্র¯ত্ম। প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ নারী দেনমোহর আদায়ে আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’

এক সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, জানুয়ারি-ডিসেম্বর-১৭ সময়ে বিবাহ-সংক্রাšত্ম ঘটনায় মামলা হয়েছে ৯৭টি এবং গ্রেফতার হয়েছে মাত্র ৭ জন। আর মামলার রায় প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ৬টি। বিয়ে-সংক্রাšত্ম ঘটনায় রায় হয় খুব কম। আপস রফা করা, সময়মতো পুলিশের তদšত্ম রিপোর্ট না দেওয়া এবং বিয়ের কোনো প্রমাণপত্র যেমন-কাবিননাম, ছবি, রেজিস্ট্রেশন না থাকা। মামলা কম হওয়ার আরেক কারণ নারীরা লোকলজ্জা ও অপবাদের ভয়ে সাধারণত মামলা করে না। গ্রাম্য সালিসের মাধ্যমে অনেক ঘটনার নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। যদিও বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ৪৯৩ ধারা অনুযায়ী, প্রতারণা বা প্রবঞ্চনা করে কোনো নারীকে বিয়ে করে বিয়ে-পরবর্তী কার্যবিধি সম্পাদন না করার অপরাধে কোনো ব্যক্তি ১০ বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন।

দেনমোহর থেকে নারীকে বঞ্চিত করা একটি সামাজিক অপরাধ। বর্তমানে ইউনিসেফ, এনজিওসমূহ ও সরকারের প্রচেষ্টায় অবস্থার পরিবর্তন ও উন্নতি ঘটছে। নারীরা বিয়ের কাবিন বা রেজিস্ট্রেশনের গুরূত্ব উপলব্ধি করতে পারছেন। সরল বিশ্বাসী ফেরদৌসীর মতো প্রকা- ভুল করে আর কেউ হয়তো রেজিস্ট্রেশনবিহীন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উপড়ে ফেলবেন না জীবনী শক্তির মূল শেকড় বা উৎস।

লেখক : গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist