সাধন সরকার

  ২৫ এপ্রিল, ২০১৮

মতামত

পাহাড়ধস নিয়ে কিছু কথা

বাংলাদেশের দুর্যোগগুলোর মধ্যে পাহাড়ধস উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম এলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম) পাহাড়ধসের ঘটনা খবরের শিরোনাম হয়। ২০০৭ সাল থেকে ব্যাপকভাবে শুরু হওয়া পাহাড়ধসে মৃত্যুর কারণ যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৭ সালে ভয়াবহ পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ১২৭ জন মানুষ মারা যায়। এরপর থেকে প্রতি বছর পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছেই। সর্বশেষ ২০১৭ সালে পাহাড়ধসে ১৬০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পাহাড়ধস মূলত প্রাকৃতিক হলেও মানুষের পরিবেশ-বিধ্বংসী কার্যকলাপ পাহাড়ধসকে ত্বরান্বিত করছে। যেখানে পাহাড় আছে, সেখানে পাহাড়ধস হবে এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। পৃথিবীর উন্নত দেশে কমবেশি পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটলেও সেসব দেশে বেশিসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে না। কেননা উন্নত দেশে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়িবসতি নিষিদ্ধ এবং এ ব্যাপারে পরিকল্পিত ও বিভিন্ন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা বিদ্যমান। বাংলাদেশের অধিকাংশ পাহাড় পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। মূলত পাহাড়ের ঢাল আর ভূতাত্ত্বিক গঠনবিন্যাসের কারণে পাহাড়ধসের ঝুঁকি তৈরি হয়। এ দেশের বেশির ভাগ পাহাড় পূর্ব-পশ্চিমে ঢালু। ফলে ভারী বা একটানা বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ধসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

পাহাড়ধসের আশঙ্কা এ বছর বেশি করে ভাবিয়ে তোলার অন্য আর একটি কারণ হলো রোহিঙ্গা বসতি। মিয়ানমারের পরিকল্পিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে চলে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলোর পাহাড়ের ঢালে। রোহিঙ্গারা পাহাড় কেটে বসতি তৈরি করেছে। বন ধ্বংস করে, প্রাকৃতিক বন থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে তারা তাদের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। বাছ-বিচারহীনভাবে পাহাড় ও বন কেটে পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট খুপরিঘর বানিয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছে। পাহাড়ের ওপর বাড়তি এ অত্যাচারের মাধ্যমে পাহাড়ধসকে জেনেশুনে স্বাগত জানানো হচ্ছে না তো? প্রতি বছর বিভিন্ন কারণে পাহাড় ও গাছপালা এমনিতেই কমে আসছে। অথচ প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় ও গাছপালার ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩০ ডিগ্রির বেশি ঢালু পাহাড়ের পাদদেশে মূলত পাহাড়ধসের অবস্থা তৈরি হয়। রোহিঙ্গা বসতি তৈরিতে এসব কোনো কিছুর তোয়াক্কা করা হচ্ছে বলে মনে হয় না। পাহাড়ে এখন আর ঘন বনভূমি দেখা যায় না। বন কেটে পাহাড়কে নাজুক করা হয়েছে। পাহাড়-বন নানাভাবে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। পাহাড়-বন কেটে অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস গড়ে তোলাসহ পাহাড় কেটে আবাসন প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। পাহাড়ের পাদদেশে ছেয়ে গেছে ছোট ছোট হাজার হাজার বসতঘর। আগে যখন পাহাড়ে ঘন বনায়ন ছিল, তখন ঘন বনায়নের জন্য বৃষ্টিপাত পাহাড়ের শিলাস্তরে ঢুকতে পারত না। বৃষ্টির পানি পাহাড়ের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে যেত। এর ফলে পাহাড়ের ভেতরের মাটির গঠনও ঠিক থাকত। কিন্তু বন ধ্বংসের ফলে পাহাড় ন্যাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি শিলাস্তরে ঢুকে পাহাড়ধসকে ত্বরান্বিত করছে। একটানা কয়েক দিন বৃষ্টিপাত বা ভারী বৃষ্টিপাত আর এলোমেলো রোহিঙ্গা বসতির কারণে পাহাড়ধসে মৃত্যুর সংখ্যা এবার সব রেকর্ড ছাপিয়ে যেতে পারে! এখনই জরুরি সতর্কতা জারি করা দরকার। পাহাড়ের অনেক স্থানের বনভূমি কেটে কৃষিজমিতে রূপান্তর করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের কারণেও পাহাড়ধসের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে একটার পর একটা পাহাড়ধস হয় আর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। নানা পদক্ষেপের কথা শোনা যায়। পাহাড়ধসের পর বিভিন্ন কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয় কিনা সন্দেহ! গরিব-অসহায় লোকজন বছরের পর বছর খুপরিঘর তৈরি করে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। তাদের পাহাড়ের পাদদেশ থেকে সরিয়ে স্থায়ী পুনর্বাসনের দাবি দীর্ঘদিনের। ক্রমাগতভাবে পাহাড়ি অঞ্চলে জনসংখ্যা বাড়ছে। পাহাড় ও বনের ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাকৃতিক বন-জঙ্গল উজাড় করে পাহাড়ে ব্যাপকভাবে রাবার ও তামাকের চাষ করা হচ্ছে। এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। মোটকথা হলো, পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দিতে হবে।

বর্ষা মৌসুমে এবং স্থায়ীভাবে পাহাড়ধস ঠেকাতে যেসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত তা হলোÑ১. ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসতি স্থাপন স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ ও তদারকি করতে হবে। ২. নির্বিচারে পাহাড়-বন কাটা বন্ধ করতে হবে। ৩. পাহাড় জবরদখল ও অবৈধভাবে পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. যেকোনো ধরনের উন্নয়নকাজে পাহাড়ের গঠনবিন্যাসকে বিবেচনায় নিতে হবে। ৫. পাহাড় ও বন রক্ষার স্বার্থে তথা পাহাড়ধস ঠেকাতে রোহিঙ্গা বসতি পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অন্যত্র সুবিধাজনক স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। ৬. পাহাড় ইজারা দেওয়া বন্ধসহ পাহাড়ে জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন ও ঢালু পাহাড়ে গাইড ওয়াল নির্মাণ করতে হবে। ৭. পাহাড়ি কিংবা বাঙালি হোক সব ধরনের বসতি পার্বত্যবান্ধব উপায়ে তৈরি করতে হবে। ৮. সর্বোপরি পাহাড়ধস বন্ধে স্বল্প, দীর্ঘমেয়াদিসহ সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আশাকরি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist