জি. কে. সাদিক

  ২৫ এপ্রিল, ২০১৮

পরামর্শ

বেকার সমস্যা সমাধান

বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মধ্যে বেকারত্বের হার নিয়ে এক ধরনের টানাটানি চলছে। আমি সে ঝামেলায় না জড়িয়ে বেকার সমস্যার সমাধান কল্পে কিছু করণীয় নিয়ে আলোচনা করব। প্রথম কথা হলো, বেকার সমস্যা সৃষ্টি ক্রমেই প্রকট হচ্ছে কেন, সে কারণগুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে এর সমাধানে কাজ করা। আর একটা অপ্রিয় সত্য বিষয় আমাদের মেনে নিতে হবে। সেটা হলো বর্তমান বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় নানাবিধ কারণে বেকার সমস্যা বাড়ছে। জার্মানি ও রাশিয়ার মতো উন্নত দেশেও বেকার সমস্যা ক্রমবর্ধমান। আমেরিকা, সৌদি আরব, ভারতের মতো দেশও বেকার সমস্যায় ভুক্তভোগী। কিন্তু এ সমস্যা থেকে তাদের উত্তরণ প্রচেষ্টা ও সফলতা আমাদের চেয়ে ভালো। আমাদের দেশে বেকার সমস্যার সমাধানে সরকার নানা প্রদক্ষেপ নিচ্ছে বটে, তবে সেটা বেশ কিছু কারণে তেমন ফলপ্রসূ হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে এ প্রচেষ্টা অপাত্রে কন্যা দানের মতো হচ্ছে।

গত ৩১ মার্চ বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্কিলস ফর টুমোরোস জবস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কলেজগুলো থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা ৭০ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট বেকার থাকে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং প্রতি বছর ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। এর মধ্যে স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থানে প্রবেশ করতে পারছে পাঁচ লাখের কিছু বেশি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ কর্তৃক প্রকাশিত ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শীর্ষক সমীক্ষা মতে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের (অনার্স-মাস্টার্স) মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এ হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে কেন বেকারত্বের হার বাড়ছে? যদিও এ আলোচনা চর্বিতচর্বণ হবে তবু করছি। অন্যতম কারণ হচ্ছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সমন্বয়হীনতা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো বাজার চাহিদার আলোকে প্রণোয়ন হয়নি। যার কারণে শিক্ষিতজনদের শিক্ষা পাকস্থলীর নয় গোদাম জাত দ্রব্য হয়ে আছে। কিছু দেশ আছে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। আর কিছু দেশ আছে মানবসম্পদের ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোও যদি মানবসম্পদে উন্নতি করতে না পারে, তাহলে প্রাকৃতিক সম্পদের ফল ভোগ করতে পারে না। যেমন নাইজেরিয়া তেলসমৃদ্ধ দেশ হয়েও মানবসম্পদের উন্নতি করতে না পারায় প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারছে না। আফ্রিকার কঙ্গো, সুদান, লাতিন আমেরিকা ব্রাজিল মানবসম্পদে উন্নত না হওয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বে উন্নতি করতে পারেনি। এদিকে সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ের মতো দেশগুলো মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের মাধ্যমে উন্নতি করছে। অন্যদিকে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। যে দেশগুলোয় প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন নেই কিন্তু মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করেছে। মেইজি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে জাপানের অবস্থান বাংলাদেশের মতোই ছিল। ১৮৭৭ সালে জাপানের টোকিওতে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হয়। ১৮৮০ সাল থেকে গ্র্যাজুয়েট বের হতে থাকে। এ গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে ৯০ শতাংশ ছিল ফিজিকস, কেমিস্ট্রি ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের। কারণ সে সময় জাপানে এ শাখায় জনবলের চাহিদা ছিল। তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয় চাহিদার আলোকে প্রস্তুত করেছিল। তাই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল না হয়েও জাপান উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। তাই শিক্ষার হার বাড়ালেই হবে না। জানতে হবে কী ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বড় ধরনের ফারাক আছে চাহিদাবিধির। বর্তমানে দেশের ৩০ দশমিক ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী কলা ও মানবিক শাখায় অধ্যয়নরত। তবে এ শাখার বাজার চাহিদা ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। তাহলে বাড়তি ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার সমস্যার কারণ হবে। অন্যদিকে ব্যবসা শিক্ষা শাখায় চাহিদা ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ থাকলেও এ খাতে উৎপাদন ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বিজ্ঞান শাখায় চাহিদা ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ; কিন্তু জোগান মাত্র ৮ শতাংশ। চিকিৎসা বিজ্ঞান শাখায় চাহিদা ১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে জোগান শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। জোগান ও চাহিদাবিধির এমন অসামঞ্জস্য বেকার সমস্যাকে আরো চাউর করছে। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও ব্যবসা শাখায় জনবল বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষা আমাদের দেশে অনেকটাই অবহেলিত। যদিও সরকার অন্তরিকতা দেখাচ্ছে তথাপি সেটা অপ্রতুল। আমাদের দেশে গ্র্যাজুয়েট লেভেলে কারিগরি শিক্ষায় পাসের হার মাত্র ৩ শতাংশ, অবশ্য সরকার বলছে ১০ শতাংশ, কিন্তু এটি ভারতে ২৭ শতাংশ, নেপালে ২৩ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪০ শতাংশ এবং উন্নত দেশে ৬০ শতাংশের বেশি। চীনের ৫১ শতাংশ মানুষ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত। আর দেশেও যেমন এ শিক্ষার চাহিদা, তেমনি দেশের বাইরেও অনেক বেশি। ইরাক, চীন, জাপান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসহ ইউরোপেও কারিগরি শিক্ষায় জনবলের চাহিদা রয়েছে। দেশের ভেতরেও কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যা ক্রমে বাড়ছে। সুতরাং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন পরিবর্তন আনতে হবে, তেমিন জোর দিতে হবে কারিগরি শিক্ষা খাতে। দেশে একটি অপার সম্ভাবনাময় শিল্প হচ্ছে সারা দেশে স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র হালকা ও মাঝারি আকারের শিল্প-কারখানা। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির (বাইশিমাস) তথ্য মতে, সারা দেশে ৮৭ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র হালকা ও মাঝারি শিল্প-কারখানা রয়েছে। দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে এ শিল্পে প্রতি বছর টার্নওভার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫০ কোটি টাকারও বেশি। মোট জিডিপিতে এ খাতের অবদান ২৫ শতাংশ। এ খাতে ৩৫ লাখ কর্মীসহ দেড় কোটি মানুষের জীবিকা জড়িয়ে আছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশের তৈরি প্লাস্টিকের খেলনা পৃথিবীর ৩৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে। যার রফতানি আয় ১২৬ কোটি টাকা। অপার সম্ভাবনাময় এ খাতের ৯০ শতাংশই রুগ্ণভাবে চলছে। আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, চলতি মূলধন সংকটসহ প্রশাসনে নানা উৎপীড়নের এ খাত সুজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। ৮৬ হাজার ৪১২টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে ৭২ হাজার ৩০০ প্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হয়ে আছে। বছরের অর্ধেকটা সময় বন্ধ থাকছে কারখানাগুলো। ৪ হাজার ১১২টি কারখানা চলছে ধুঁকে ধুঁকে। স্বল্পপুঁজি দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া, একই সঙ্গে স্বল্প পরিসরে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে যেমন বেকার সমস্যার সমাধান সম্ভব, তেমনি দেশের রফতানি আয় বৃৃৃৃৃৃদ্ধিও হবে। তাই এ খাতের উন্নয়নের জন্য ব্যাংকঋণের ব্যবস্থাসহ সরকারিভাবে সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

প্রথমে শিক্ষাব্যবস্থার অসামঞ্জস্যের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এবং কারিগরি শিক্ষার চাহিদার কথা বলা হয়েছে। কারিগরি শিক্ষায় উন্নতি করা সম্ভব হলে দেশের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর ব্যবহার যেমন নিশ্চিত করা যাবে, তেমনি চাহিদার আলোকে দেশে ও বিদেশে দক্ষ মানবসম্পদের জোগান দিয়ে বেকার সমস্যা সমাধান সম্ভব। অন্যদিকে দেশে ও বিদেশে ক্ষুদ্র হালকা ও মাঝারিশিল্পের যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, সে আলোকে এ খাতে উন্নয়ন করতে পারলে কর্মসংস্থানের অভাব পূরণ হবে। একই সঙ্গে সরকারের ঘাড়ে চাকরির ব্যবস্থা করার যে খড়গ আছে, সে চাপও কমবে এবং ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগতা হতে উৎসাহিত করবে। এ ছাড়া বেকার সমস্যার সমাধান করতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সেটা শুধু প্রধান শহরগুলোকেন্দ্রিক না করে বিকেন্দ্রীকরণ করে করলে অধিক ফলপ্রসূ হবে। তা না হলে আয়বৈষম্য আরো চরমে উঠবে, বাড়বে বেকার সমস্যা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist