মীর আবদুল আলীম

  ২৩ এপ্রিল, ২০১৮

বিশ্লেষণ

দুর্ঘটনার নামে হত্যাকান্ড

সড়কে আইন মানছেন না কেউ। আসলে সড়কে আইন মানতে বাধ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাহলে কীভাবে সড়ক নৈরাজ্য থামবে? এ নিয়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের ভাবনা কম। যারা সড়কে আইন মানানোর কাজ করেন, তারাই আইন মানেন না। পত্রিকায় দেখি, সড়কে ঘুষের মহোৎসব চালায় পুলিশ। তাদের ব্যস্ত সময় নাকি কাটে উপরি কামাইয়ে। সড়কে আইন না মানা ড্রাইভার, পথচারীদের নিয়ন্ত্রণে তাদের এন্তার সময় কোথায়? তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ হবে কী করে? আমরা কি অন্ধ! প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে, প্রতিদিন সংবাদপত্রগুলো ফলাও করে সংবাদ ছাপছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মড়ক লাগায় জাতীয় প্রথম শ্রেণির একটি পত্রিকা দেড় বছর ধরেই প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিশেষ সংবাদ ছাপছে। সবাই দেখেন; দুর্ঘটনা নিয়ে ভাবেন। ভাবলেসহীন থাকতেই ভালোবাসেন।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ নয়। মানবসৃষ্ট কারণেই প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সে হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার উদ্যোগ নেই বাংলাদেশে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারেই বেড়ে চলেছে। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে না। বিগত এরশাদ সরকারের আমলে সড়ক দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে সরকার দুর্ঘটনা সংঘটনকারী গাড়ির চালকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। এতে চালকের দায়িত্ব অবহেলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু ঘটলে এ জন্য চালককে নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পড়ে তা রহিত করতে বাধ্য হয় সরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন সরকারকে পরিবহন শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার কাছে প্রায় জিম্মি থাকতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে দুর্ঘটনা সংঘটনকারী চালকদের শাস্তি না হওয়া, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালক কর্তৃক গাড়ি চালানো, আনফিট গাড়ি রাস্তায় চালানো, সড়ক যোগাযোগে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে ইদানীং সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত চালকদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ঘটনা এ দেশে বিরল। দেখা গেছে, প্রায় সব কটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই চালকরা পার পেয়ে গেছে। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে। উৎকোচ কিংবা অর্থ ভাগাভাগির মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটেছে এসব ঘটনার।

সরকারি হিসাবে গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে ৩৪ হাজার ৯১৮ জন। প্রতি বছর মারা যায় ৩ হাজার ৪৯১ জন। থানায় মামলা হয়েছে এমন দুর্ঘটনার হিসাব নিয়ে পুলিশ এ তথ্য দিয়েছে। বেসরকারি হিসাবে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ২০ হাজার ৩৪ জন। প্রতিদিন গড়ে মারা যায় প্রায় ৫৫ জন। পুলিশের দেয় তথ্য ও বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকার কারণ হলো, দুর্ঘটনার পর পুলিশকে ৬৭ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ ঝামেলার কারণে অনেক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশ রেকর্ডভুক্ত করে না। এর পরও পুলিশের দেয় তথ্যানুযায়ী ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে প্রায় ২ হাজার ১৪০ জন। মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে ১ হাজার ১৮৬ এবং সামান্য আহত হয়েছে ১৫৭ জন। অন্য একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭২ হাজার ৭৪৮টি। মারা গেছে ৫২ হাজার ৬৮৪ জন। আহত ও পঙ্গু হয়েছে আরো কয়েক হাজার মানুষ। ২০০৯ সালের এক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায় এশিয়া, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা নেপালে বেশি, দ্বিতীয় বাংলাদেশ। সবচেয়ে কম যুক্তরাজ্যে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের দুর্ঘটনায় নেপালে মারা যায় ৬৩ জন এবং বাংলাদেশে ৬০ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ওই গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের প্রায় ৩২ শতাংশ ১৬ থেকে ৩২ বছর বয়সের মধ্যে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে যানবাহন দুর্ঘটনায় বছরে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায় এবং আহত ও পুঙ্গ হয়ে পরনির্ভরশীল জীবন কাটাতে বাধ্য হয় এর চেয়েও অনেক বেশি মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতির সাম্প্রতিক এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ফি বছর ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদহানি হয়। এটি দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৯৫ শতাংশের সমান। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বেশি। এক গবেষণা জরিপ থেকে জানা যায়, ৪৮ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যাত্রীবাহী বাস, ৩৭ শতাংশ দায়ী ট্রাক। নানা কারণে দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরযানে ১০০টি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক হাজার মোটরযানে ২ দশমিক ৫ ভাগ থেকে ৩ দশমিক ৫ ভাগ। অন্যদিকে আমাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার যানবাহনে ১৬৩ জন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। সরকারি হিসাব মতে, ১৯৯৯ সালে ৪ হাজার ৯১৬, ২০০০ সালে ৪ হাজার ৩৫৭, ২০০১ সালে ৪ হাজার ৯১, ২০০২ সালে ৪ হাজার ৯১৮, ২০০৩ সালে ৪ হাজার ৭৪৯, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৮২৮, ২০০৫ সালে ৩ হাজার ৯৫৪, ২০০৬ সালে ৩ হাজার ৭৯৪, ২০০৭ সালে ৪ হাজার ৮৬৯, ২০০৮ সালে ৪ হাজার ৪২৬, ২০০৯ সালে ৪ হাজার ২৯৭, ২০১০ সালে ৫ হাজার ৮০৩, ২০১১ সালে ৩ হাজার ৬৮৮, ২০১২ সালে ৫ হাজার ৯১১, ২০১৩ সালে ৪ হাজার ৮৬৫ জন এবং ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৯৭৫, ২০১৫ সালে ৮ হাজার ৬৪২, ২০১৬ সালে ৭ হাজার ৪২৭ ও ২০১৭ সালে ৮ হাজার ৬৯৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে।

প্রতি বছরই এভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে আর তা রোধ করা যাচ্ছে না। অদক্ষ ও দুই নম্বর লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকরাই যে এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী তা বলাই বাহুল্য। এর প্রতিকার কেউ করছে না। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ র‌্যাববাহিনী গঠন করা যায়, দুর্ঘটনা রোধে এ জাতীয় বাহিনী নয় কেন? এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে সন্ত্রাসীদের হাতে শতকরা ৩০ জন লোক মারা গেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ৭০ জন। ৩০ জনের জীবনসহ অপরাপর জানমাল রক্ষায় সরকারের একটি বাহিনী থাকলে শতকরা ৭০ জনের জীবনসহ অসংখ্য আহত ও ডলারে কেনা পরিবহন রক্ষায় সরকার সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বাহিনী গঠন করছে না কেন? দেশের মানুষের জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দুর্ঘটনা রোধে চরমভাবে ব্যর্থ সরকারকে দেশের মানুষের স্বার্থে যথাসম্ভব দ্রুত ভাবতে হবে। আমরা জেনেছি, কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়ই দেশে গড়ে প্রতিদিন ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটছে। এ হিসাবে মাসে ৯০০ জন এবং বছরে ১০ হাজার ৮০০ জন মারা যাচ্ছে। তবে বিআরটিএর পরিসংখ্যান মতে, এ সংখ্যা দিনে ১৬ এবং বছরে ৫ হাজার ৭৬০ জন। আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এ ক্ষেত্রে সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ চলমান প্রশাসন এ আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে তাদের ঢেলে সাজাতে হবে, অন্যথায় দুর্ঘটনা রোধে নতুন করে র‌্যাবের মতো দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হবে।

যেকোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেওয়া আরো কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারো কাছেই কাম্য নয়। আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত, আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist