সাধন সরকার

  ২২ এপ্রিল, ২০১৮

মতামত

বন ব্যবস্থাপনা জরুরি

বন একটি জাতীয় সম্পদ। বনভূমি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, প্রাণভরে অক্সিজেন গ্রহণ, ছায়া প্রদান, ওষুধ, খাদ্য, আশ্রয়, জ্বালানি সরবরাহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা, নির্মল বায়ুপ্রাপ্তি, বিনোদনসহ সর্বোপরি জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এশিয়ার যে দেশগুলোয় বনভূমির পরিমাণ সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ সেসব দেশগুলোর একটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষির সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন, নগরায়ণসহ নানা কারণে বনভূমির পরিমাণ কমছে। যেকোনো দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে মোট আয়তনের ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। এর মধ্যে আবার মাত্র ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। বাংলাদেশে দুই ধরনের বনভূমির মধ্যে প্রাকৃতিক আচ্ছাদিত বনের পরিমাণ প্রতিদিন কমছে। কিন্তু আশার কথা, বন বিভাগের এক গবেষণা বলছে বনের বাইরে তথা সামাজিক বনায়নের পরিমাণ বাড়ছে। মূলত সাধারণ মানুষের সচেতনতা, কমিউনিটিভিত্তিক উদ্যোগ এবং সরকারের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে গাছের সংখ্যা বাড়ছে। জমির পাশে রাস্তার ধারে, নতুন করে জেগে ওঠা চরে ও উপকূল অঞ্চলে বৃক্ষরাজির সংখ্যা বাড়ছে। তবে তিন ধরনের প্রাকৃতিক বনের (ম্যানগ্রোভ বন, পাহাড়ি বন, শালবন) আয়তন প্রতিদিন একটু একটু করে কমে যাচ্ছে। উন্মুক্ত সামাজিক বনায়ন যদি বাড়ানো যায় তাহলে সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বন কেন কমে যাচ্ছে? সংরক্ষিত বনের আশপাশের জনগোষ্ঠীর বিকল্প জ্বালানি কিংবা জীবিকার সন্ধান না দেওয়া, বনের জমি বন্দোবস্ত দেওয়া, যথাযথ পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টির অভাব ও বাছবিচারহীন উন্নয়নে প্রাকৃতিক বনভূমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ছাড়া আর কোথাও শালবন নেই। এ অঞ্চলে শালবনের পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে। প্রাকৃতিক বন এমনিতেই প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যে বন তৈরিতে মানুষের কোনো হাত নেই; কিন্তু সেই প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের জন্য মানুষই প্রধানত দায়ী। সুন্দরবন ও পাহাড়ি অঞ্চলের বনভূমির পরিমাণও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও পরিকল্পিত গণহত্যার শিকার হয়ে বিতাড়িত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার পার্বত্য অঞ্চলে আবাসস্থলের কারণে পাহাড়ি বনের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ব্যাপকহারে বনভূমি ধ্বংস, পাহাড় কাটা ও গাছপালা উজাড় করা হচ্ছে।

দূষণ আর শিল্পায়নের চাপে বাংলাদেশের ব-দ্বীপ সুন্দরবনের অবস্থা কাহিল। সুন্দরবনে বয়ে যাওয়া নদীতে লবণাক্ততা ও পানিদূষণের পরিমাণ বাড়ছে। সুন্দরবনে মিঠাপানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় অনেক ধরনের উদ্ভিদ মরে যাচ্ছে। এ ছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলের অধিবাসীরা জীবন- জীবিকার তাগিদে বন ধ্বংস করছে। সর্বোপরি বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বিভিন্ন দুর্যোগে প্রাকৃতিক বন আমাদের আগলে রেখেছে। এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বনভূমির পরিমাণ বাড়ানো গেলে তা বড় ধরনের দুর্যোগে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বনভূমি জলবায়ু পরিবর্তনের নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। ক্রমাগত বনভূমি ধ্বংস জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। কার্বন নিঃসরণ কমানোসহ বৃষ্টির পানি মাটিতে ধরে রাখার ক্ষেত্রে বনভূমির ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান সময়ে নগর বনায়নের ওপর বিশ্বব্যাপী গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। নগর বনায়ন নগরের বায়ুদূষণ রোধ, চিত্তবিনোদন, সৌন্দর্য বৃদ্ধি, খাদ্যের জোগান, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও পরিকল্পিত নগর গড়তে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নগরবাসীর সুস্থতায় একটি শহরের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সর্বোচ্চ নয় বর্গমিটার সবুজের আচ্ছাদন থাকা দরকার; কিন্তু ঢাকায় রয়েছে দুই বর্গমিটারেরও কম। ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদূষণ শহরগুলোর মধ্যে একটি। মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণে নানাবিধ রোগসহ প্রতিনিয়ত নগরবাসীকে ভুগতে হচ্ছে। এ ছাড়া শহরের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগরায়ণের কারণে প্রকৃতি ধ্বংস করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসন। ঢাকা শহরে সবুজের সমারোহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। নগরের রাস্তার পাশে, খাল-জলাভূমির পাশে, স্কুল-কলেজে, পতিত জমিতে, অফিস-আদালতে, বাসাবাড়ির আঙ্গিনায়, নগরের সব ধরনের বাসাবাড়ি ও অট্টালিকার ছাদে পরিকল্পিত বনায়ন করা গেলে নগরবাসীর ফুসফুস বিষবাষ্প থেকে রক্ষা পাবে।

মানুষের অসচেতনতা, বনভূমির অর্থনৈতিক ও জীবনরক্ষাকারী গুরুত্ব না জানার ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ানো-ছিটানো বনাঞ্চলও কেটে উজাড় করা হচ্ছে। সুন্দরভাবে জীবনযাপন করা ও প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য বনভূমি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বনভূমি ধ্বংস হলে দেশের ওপর প্রাকৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। বনভূমি কমে যাওয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো মরুময়তা সৃষ্টি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিপদকে আলিঙ্গন করা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে সরকার বনভূমির পরিমাণ ২০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সারা দেশের প্রাকৃতিক বনভূমি সংরক্ষণ, সামাজিক বনায়ন বৃদ্ধি, নগর এলাকায় সবুজায়ন তৈরিসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক অবয়ব সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়াটাই আজ সময়ের দাবি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist