দিলীপ কুমার আগরওয়ালা
মতামত
প্লাস্টিকশিল্প এবং...
নব্বইয়ের দশক থেকে পোশাকশিল্পের পাশাপাশি প্লাস্টিকশিল্পেও নীরব বিপ্লব ঘটেছে বাংলাদেশে। তৈরি পোশাকশিল্পের সাফল্য তো রূপকথার কাহিনিকেও হার মানায়। নিঃস্বজনের রাজা হয়ে ওঠার উপমাই এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। নব্বইয়ের দশকের আগে বংলাদেশের মানুষ পশ্চিমা বিশ্বের পুরোনো পোশাকের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। পদ্মা মেঘনা যমুনা বুড়িগঙ্গা পারের সেই দেশই এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ। এ দেশে প্লাস্টিকশিল্পের যাত্রা শুরু সেই পঞ্চাশ দশকের শুরুতে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এ শিল্প এতটাই এগিয়েছে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১২তম প্লাস্টিক পণ্য রফতানিকারক দেশ। প্লাস্টিকসামগ্রী দিয়ে এখন দেশে কাঠের বিকল্প ফার্নিচার, টেবিল-চেয়ার থেকে শুরু করে গৃহসামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে। দিন দিন এর ব্যাপক ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্লাস্টিক দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের পাশাপাশি বিশ্বে এখন ক্যানসারের ওষুধও প্রস্তুত করা হচ্ছে।
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কৌশলের (ইএমএস) যথাযথ বাস্তবায়ন হলে প্লাস্টিক ক্ষতিকর নয় বরং প্লাস্টিকের কৌশলগত রিসাইক্লিং বিপুল অর্থ সাশ্রয় করতে পারে। প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করার ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহনের ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রতি বছর তিন কোটি আট লাখ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে এবং প্লাস্টিক রিসাইক্লিং দুই-তৃতীয়াংশ জ্বালানি সাশ্রয়, পরিবেশদূষণ এবং পানি ব্যবহার প্রায় ৯০ শতাংশ হ্রাস করেছে। বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় বর্তমানে প্রতিদিন ১৩০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে এবং এর ৭০ শতাংশ (প্রায় ৯০ টন) রিসাইকেল হয়ে নতুন পণ্য হিসেবে বাজারে ফিরে আসছে। রিসাইক্লিংয়ের ফলে বর্তমানে প্রতি বছর ডিসিসি এলাকায় শূন্য দশমিক ৫ কোটি ১০ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে প্লাস্টিক আমদানি হ্রাস পাওয়া ছাড়াও মহানগরীতে ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কৃষিতে সেচপাইপ, অ্যাগ্রিকালচারাল, পলিথিন, ড্রামসিডার প্যাকেজিংসহ অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে প্লাস্টিকশিল্প। বর্তমানে বাংলাদেশে রফতানি আয়ের দিক দিয়ে প্লাস্টিক পণ্য রফতানি খাতের স্থান হচ্ছে ১২তম। আশা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্য রফতানি খাত অন্যতম শীর্ষ রফতানি খাতে পরিণত হবে। তাহলে এ খাতে রফতানি দাঁড়াবে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্লাস্টিক পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেÑমার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশসহ সমগ্র ইউরোপে এবং এশিয়ার চীন, ভারত, নেপালসহ অন্যান্য দেশে রফতানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে প্লাস্টিকের তৈরি পণ্যের প্রচ্ছন্ন রফতানির পরিমাণ বছরে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
দেশে ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। এসব কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে প্রায় পাঁচ লাখ লোক তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। প্রায় সাড়ে ৪০০ প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রফতানি করে। এসব প্লাস্টিক কারখানার বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে রাজধানী শহর ঢাকায়। কিছু রয়েছে চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে। প্রায় পাঁচ লাখ লোক এ কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকলেও, এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল এখন ২৫-৩০ লাখ লোক। পুরান ঢাকার প্রায় প্রতিটি ঘরেই গড়ে উঠেছে প্লাস্টিক কারখানা। এসব কারখানায় যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই একসময় নিজেরাই কারখানার মালিক হয়ে যান। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে স্বল্প পুঁজি নিয়েই একসময় তারা কারখানা খুলে বসেন। এভাবে এরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েও যান! সে ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধিষ্ণু এ শিল্প খাতটির প্রতি সরকারের আরো একটু সুদৃষ্টি আশা করাটা অনুচিত হবে না নিশ্চয়ই। কেননা এ প্লাস্টিকসামগ্রী উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে সরকারি কোষাগারে এরই মধ্যে জমা হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্যের চাহিদা মিটিয়ে তবেই বিদেশে রফতানি হচ্ছে আমাদের প্লাস্টিক পণ্য। তবে কিছু অপূর্ণতার জন্য এখনো সম্পূর্ণতা পায়নি প্লাস্টিক খেলনাসামগ্রীর ব্যাপারটি। একসময় আমাদের দেশের প্লাস্টিক খেলনার প্রায় সবই আসত চীন থেকে। এখন ৬০ শতাংশ প্লাস্টিকের খেলনা তৈরি হচ্ছে দেশেই। আর একটু সহযোগিতা ৬০ শতাংশকে শতভাগে পৌঁছে দেবে নিশ্চয়ই। প্রযুক্তিগত দিক থেকে যদি এ সহযোগিতার হাতটি সম্প্রসারিত হয়, তো আমরা শুধু চীন নয়, অনেক উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারবে বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতির এ সম্ভাবনাময় খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারি পর্যায়েও নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। প্লাস্টিক পণ্যে বৈচিত্র্য এনে দেশি-বিদেশি ভোক্তাদের মন কীভাবে জয় করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণাও প্রয়োজন। এ শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া হলে দেশ যেমন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে, তেমনি কর্মসংস্থানেও রাখতে পারবে কার্যকর অবদান।
লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই
"