ইয়াসমীন রীমা

  ২১ এপ্রিল, ২০১৮

পর্যালোচনা

সাংবাদিকতা ও প্রতিবন্ধকতা

যোগাযোগের নেটওয়ার্কে বিশ্ব এখন এক সুতায় বাঁধা। তাই গোটা বিশ্বকে যোগাযোগের ভাষায় বলা হচ্ছে-‘গ্লোবাল ভিলেজ’। আর বাংলাদেশ নামক ভিলেজটি দুর্নীতি সত্ত্বেও উন্নয়নের এমন একসময়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যখন একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছা মাত্র দিনের ব্যাপার। এ যে বিশাল দেশটি যোগাযোগের একটি ছোট্ট গ্রামে পরিণত হয়েছে, তা শুধু সড়ক, জল বা আকাশপথে নয়। সাংবাদিকতার ভাষায় আমরা যে যোগাযোগকে গণযোগাযোগ (গঅঝঝ ঈঙগগটঘঅঈঅঞওঙঘ) বলি সে ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ আজ পরিণত হয়েছে ছোট্ট একটি গ্রামে। ঢাকা ও প্রধান শহরে তো বটেই, জেলা বা উপজেলা পর্যায়েও সংবাদপত্র বেরুচ্ছে নিয়মিত। ঢাকা থেকে প্রচারিত সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে দেশের সর্বত্র। এর পরও রয়েছে জাতীয়-আঞ্চলিক সংবাদপত্রের বিভাজন। কিন্তু ভৌত অবকাঠামোর ক্ষেত্রে যাই হোক, গণযোগাযোগের বেলায় বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলকে যে আজ আর মফস্বল বলা যাবে নাÑএ কথা যত জোরে সম্ভব, তত জোর দিয়ে বলতে হয়, আরেকটি বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে। দেশের নানা অঞ্চলে কর্মরত সাংবাদিকরা আমাদের মূলধারার সংবাদকর্মীদের থেকে এতটুকু বিচ্ছিন্ন নন। তারা মূলধারার সাংবাদিকতারই সক্রিয় অংশ। তারকা হতে হবে এমন ধারণা পোষণ না করে অনেক পথিকৃৎ সাংবাদিক আছেন জাতীয় কাগজগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পাঠিয়ে থাকেন।

রাজধানীকেন্দ্রিক লাইমলাইটের বাইরে থাকেন বলে মফস্বল সাংবাদিক বা স্থানীয় সাংবাদিক। আর এ সাংবাদিকদের যে চর্চা, তাই স্থানীয় সাংবাদিকতা বা মফস্বল সাংবাদিকতা। অবশ্য মফস্বল সাংবাদিকতাকে হাল সময়ে গ্রাম সাংবাদিকতা, প্রান্তিক সাংবাদিকতা, আঞ্চলিক সাংবাদিকতা নামেও আখ্যায়িত হয়। সত্যিকার অর্থে জেলা বা উপজেলার কিছু সাহিত্য, সংস্কৃতিমনা তরুণ-তরুণী সমাজ বদলের স্বপ্ন, গণমানুষের অধিকার আদায়ের স্বপ্ন, এমননি হাজারো স্বপ্ন বুকে লালন করে এসে সাংবাদিক হতে চায়, কিন্তু পাকা রাস্তার শেষ মাথায়ই থমকে দাঁড়ায় নগর। তাই জাতীয় পত্রিকাগুলোয় তাদের জায়গায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে সীমারেখা আছে। ফলে ওই সীমাবদ্ধ জায়গায় শুধু প্রান্তিক মানুষের পড়ে পড়ে মার খাওয়া ছাড়া কিছুই আসে না। মানুষ হিসেবে সাংবাদিকের কোনো শ্রেণিবিন্যাসের দরকার হয়তো নেই। তবু একটি গ-ি তৈরি হয়ে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তির কম্পিউটার ই-মেইল, ইন্টারনেট, অত্যাধুনিক অফসেট ছাপাখানার বাহারি রঙের কলেবরে দৈনিক পত্রিকার সৌন্দর্য বেড়েছে। কিন্তু উন্নত হয়নি লেখার মান ও বিষয়। প্রায় সবগুলো পত্রিকার ঝোঁক হালকা ও চটুল বিষয়ের প্রতি। জাতীয় কাগজগুলোর মূল সুর হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক কাগজগুলো পাঠককে বিন্যাসের ক্ষেত্রে আত্মতৃপ্তির সন্ধান না দিতে পারলেও শ্রেণি, ভিত্তিহীন সমাজের প্রতিটি কর্মকা-ই তুলে ধরার মনোবৃত্তি পোষণ করেন।

আমরা জানি স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতা বিস্তর সমস্যায় আকীর্ণ। কাজেই স্থানীয় প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বুঝতে হলে এসব সমস্যার আলোকে বুঝতে হবে। স্থানীয় সাংবাদিকরা কতটা লিখছেন বা লিখতে পারছেন তা তলিয়ে দেখতে হবে। না লিখতে পারলে এর অন্তর্নিহিত কারণগুলো খুঁজে দেখতে হবে। মূল কারণগুলো খুঁজে বের করতে না পারলে একই সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে থাকবে স্থানীয় সাংবাদিকতা, এগোবে না। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবনার দাবি রাখে। এমন না যে বিষয়গুলো প্রথমবার উল্লিখিত হচ্ছে। বহুজনের বহুবার উচ্চারিত বিষয়গুলো পুনঃচিন্তার খোরাক জোগায়। এর মধ্যে একটি হলো পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা গ্রহণ করতে না পারা। অন্যটি হলো স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের চাপ, হামলা-মামলা ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে নিজেদের ঘরের সমস্যা অনৈক্য ও দলাদলি। স্থানীয় পর্যায়ে যারা জাতীয় বা স্থানীয় পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন, তাদের অধিকাংশই নিয়মিত কোনো সম্মানী পান না। দু-একটি পত্রিকা সম্মানী প্রদান করলেও তা অপর্যাপ্ত। ফলে সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করার সুযোগ না থাকায় সাংবাদিকদের অন্যান্য পেশা বা কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাই সাংবাদিকতা করতে আসেন। ফলে তাদের পক্ষে পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে কাজ করা কতটা সম্ভব, সেটি ভেবে দেখা দরকার।

একটি প্রশ্নবিদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এমনকি দুষ্ট গণতন্ত্রের অবকাঠামোয় সাংবাদিকতা চর্চার ধারার অবস্থা এমন, স্বাধীনতাকে ছাপিয়ে কখনো কখনো শৃঙ্খলাই বড় হয়ে উঠছে। শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার জন্য রয়েছে ১৩টি নানান আইনের বেড়িয়ার কোনটা ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত, কোনটা পাকিস্তান আমলে আর কোনটা খোদ বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের শাসনামলেÑউপরন্তু আছে আইনবহির্ভূত নানা বিধিনিষেধের নিগড়, হুমকি চাপ-সংবাদপত্রগুলোকে বশীভূত বা দমন করার হরেক রকম কলাকৌশল। শৃঙ্খলিত সাংবাদিকতা নিশ্চিতকরণে প্রচলিত আইনের কাঠামোর কখনো আরোপিত প্রয়োগ আবার বেশির ভাগ অপপ্রয়োগের কথা বাদ দিলেও বলতে হয় অসুস্থ ও দখলদারির রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেমন মার খাচ্ছে, তেমনি সংবাদপত্রগুলোয় অসৎ ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে সুকৌশলে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা, সর্বোপরি সাংবাদিক সমাজের মধ্যকার অনৈক্য ও বিভাজন স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চার পথকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। জন্ম নিচ্ছে ‘দ’সাংবাদিকতার। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে হচ্ছে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘দ’-সাংবাদিকতার ব্যাখ্যা কেউ দলীয়, আবার কেউ দুষ্ট, দূষিত, দ-নীয়, দমনমূলক কিংবা দালালিÑএ রকম যত নেতিবাচক বিশেষণ যুক্ত করবেন, ঠিক কোনোটাই বাংলাদেশের সাংবাদিকতার আজকের পরিস্থিতিকে হয়তো ধারণ করতে পারবে না।

সরকার চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের সূত্রে ২০১৭ সালে দেশে ৩২৮টি দৈনিক এবং ৩৭৭ সাপ্তাহিকীর পাঠক সংখ্যা গড়ে ২০ লাখ আন্দাজ করা হয়েছে। এ আন্দাজ বলে দেয় সংবাদমাধ্যমে এখন মোটামুটি শিল্পে রূপ নিয়েছে। পাশাপাশি আবার দেখা যায়, পেশা ও শিল্প হিসেবে সাংবাদিকতা বর্তমানে অনেকটা স্বীকৃতি পেয়ে গেলেও অদৃশ্য সেন্সরশিপ আরোপ, দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক হুমকির কারণে স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী সমালোচনার সম্মুখীন। সাংবাদিক নির্যাতনের রেকর্ড ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চোখে অন্যতম ‘নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতার দেশ। রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সরকারি নানা বিধিনিষেধে ২০১৭ সালে দেশে ৬৫ সাংবাদিক হতাহত হয়েছেন, ৯০ সাংবাদিককে হত্যার হুমকি, ১৯ জনকে গ্রেফতার, নানান আইনে ১৪ জনকে হয়রানি এবং ৫ জনকে অপহরণ কর হয়েছে (ঞঐঊ ঘঊড অএঊ উঐঅকঅ ঋঊই ২৭.২০০৪চ-১)। দেশের প্রচলিত রাজনীতির এমন বিভক্তির পথ ধরে সাংবাদিক সমাজের মধ্যে অনৈক্য ও বিভ্রান্তির জন্ম দেয়Ñপাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়কে এড়িয়ে যায়Ñস্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চার পথকে অবরুদ্ধ করে রাখে। আজকের স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে বিশ্লেষণ করতে হলে উল্লিখিত কয়েকটি দিক বিবেচনায় আনতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ের অসংখ্য বিষয় আছে, যেগুলোর সংবাদমূল্য থাকলেও রিপোর্টিং হয় না বা সংগত কারণে সাংবাদিকরা রিপোর্ট করতে পারেন না। এর মধ্যে কিছু বিষয় আছে, যেগুলো ইচ্ছে করে ধামাচাপা দেওয়া হয়। ফলে স্থানীয় অনেক জনগুরুত্বসম্পন্ন সংবাদই আলোর মুখ দেখে না। সেসব নানা কৌশলে ধামাচাপা দেওয়া হয়। প্রশাসন বা প্রভাবশালী মহল ভয়ভীতি দেখিয়ে বা কিছু সাংবাদিকের দলীয় আনুগত্য ও অনৈক্যের সুযোগে অবাধ তথ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিরাপত্তাজনিত কারণে সংবাদ পাঠানো থেকে বিরত থাকেন অনেক স্থানীয় সাংবাদিক।

অনেককে বলতে শোনা যায়, সাংবাদিকরা সবার দুর্নীতির কথা লিখে থাকে, কিন্তু তারা কতটুকু স্বচ্ছতা বজায় রাখে তা নিয়ে কোনো লেখা হয় না। আজকের মানুষ একবাক্যে বলে থাকেনÑপুলিশ, আমলা ও রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিবাজ। কিন্তু পুলিশ আমলা ও রাজনীতিবিদদের মধ্যেও ভালো এবং সৎ মানুষ আছে। হয়তো সংখ্যা কম। ঠিক তেমনি সাংবাদিকদের মধ্যেও কেউ কেউ হয়তো দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তবে তাদের সংখ্যাও যে কম তার প্রমাণ ক্রমবর্ধমান সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সৎভাবে সত্য তুলে ধরার কারণে সাংবাদিকরা হামলা, মামলা, হুমকি হয়রানি শিকার হচ্ছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চিরতরে নিস্তব্ধ হয়ে গেছেন। যেমন নিস্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল নির্ভীক সাংবাদিক শামছুর রহমান, নহর আলী, আলাউদ্দিন, মুকুল, বজলুল রহমান, মানিক সাহা ও হারুনুর রশিদের। পুরো দেশ যখন ঝুঁকির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতায় দেশের সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে, তখন পেশাগত পরিচয়ের কারণে সাংবাদিকরা নিরাপদ থাকবে, তেমনটি আশা করা বৃথা।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি তাই খ-িত আকারে না দেখে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। রাজনৈতিক প্রশাসনিক, সামাজিক চাপ ও বিধিনিষেধ, সাংবাদিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নিজেদের মধ্যে অনৈক্য এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শুধু কথাই থেকে যাবে। তাই সাংবাদিকদের রক্ষার জন্য প্রয়োজনে আইন প্রণয়নের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে নিজেদের বিভেদ দূর করে একতাবদ্ধ হলে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে। ঐক্য এবং দায়িত্বশীলতাই হতে পারে সাংবাদিকদের রক্ষাকবচ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist