রহিম আবদুর রহিম

  ২০ এপ্রিল, ২০১৮

মতামত

সংস্কৃতি ও আমাদের অভ্যাস

২০০৭ সালে একটি স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন একজন প্রকৌশলী। যিনি পূর্ব জার্মানি থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। বক্তব্য প্রদানকালে তিনি পূর্ব জার্মানির একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা দেন। পূর্ব জার্মানির অধিবাসীরা কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ। সেখানে রান্না-বান্না থেকে শুরু করে সব কাজেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। যে কারণে, কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে চুলকাটার মতো কাজে যারা নিয়োজিত তাদের ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়। এক দিনের ঘটনা, বাংলাদেশি এই প্রকৌশলী সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে দ্রুত ক্লাসে চলে যান। দুপুরে এই ব্যক্তি যখন খাবারের জন্য কক্ষে ফিরেন তখন তিনি দেখতে পান, তার রান্না প্রকৌশলী (বাবুর্চি) ষাটোর্ধ্ব মহিলা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রকৌশলী তার কাছে আসা মাত্র খাবার দেওয়া তো দূরের কথা চোখ রাঙিয়ে তাকে বললেন, ‘তুমি আমার দেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছ, আমি তোমাকে আর রান্না করে খাওয়াব না।’ মহিলা এই বলে তার রান্নাঘরের চাবি হস্তান্তর করেন। এবার বাংলাদেশি এই প্রকৌশলী কী হয়েছে জানতে চাইলে, বৃদ্ধা বলেন, ‘তুমি কেন অপ্রয়োজনে লাইট জ্বালিয়ে রেখেছিলে।’ সবিশেষ এই প্রকৌশলী এই মহিলার কাছে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন।’ তার এই অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে বাকি থাকে না, একজন সাধারণ মানুষ কতটুকু দেশপ্রেমিক হলে এ ধরনের আচরণ মালিকের সঙ্গে করতে পারেন। অথচ আমরা! যেভাবে বিদ্যুৎ, পানিসহ প্রায় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করছি, তাতে আমাদের দেশপ্রেমের দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। লোডসেডিংয়ের পর বিদ্যুৎ আসলে সব সুইচ অন করে ক্ষতিপূরণের সংস্কৃতি আমরা অহরহ দেখছি। পানির ট্যাপ ছেড়ে রাখা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি জাপান ফেরত এক ব্যক্তির সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়েছে। তিনি জানালেন, ওই দেশের কর্মছাড়া অর্থাৎ কোনো মানুষই বেকার নয়। তাদের কোনো অর্থের অভাবও নেই। সরকারের ট্যাক্স পরিশোধ করার জন্য ওই দেশের অধিবাসীরা অস্থির হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা সারা দিনের আয়-ব্যয়ের হিসাব শেষে রাষ্ট্রের পাওনা ট্যাক্স তাৎক্ষণিক পরিশোধ করেন। দোকানদাররা বাকিতে পণ্য বিক্রি করেন ঠিকই, তবে সরকারি ভ্যাট ক্রেতার কাছ থেকে তাৎক্ষণিক রেখে দেন। ফলে সরকারের কোষাগার সবসময় পূর্ণ থাকে। রাষ্ট্রের সব ব্যয়ভার বহন শেষে ওই দেশের সরকার পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য সহযোগিতা দেন। অপূর্ব!

যতদুর জানি বাংলাদেশ সরকার গত ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মোট তিন বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ করতে হয়েছে। সরকার থেকে সেবা পেতে চাই, তবে দিতে চাই না। সরকার, রাষ্ট্রের আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান নয় এবং জন বিচ্ছিন্ন কোন ভূ-খন্ডও নয়; রাষ্ট্র ও সরকার সমষ্টিগত জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ। যার চূড়ান্ত ফলাফলে পৌঁছতে হলে সমন্বিত সহযোগিতার বিকল্প নেই। বিনা টিকেটে ট্রেন ভ্রমণ, রাষ্টীয় সম্পদের অপচয়, সরকারি জায়গা জমি দখল, ক্ষমতার অপব্যবহার ঘুষ, অবৈধ সম্পদ অর্জন, অর্থ পাচার ও সরকারি সম্পদ এবং অর্থ আত্মসাতের মতো অপরাধ অহরহ হচ্ছে। নানাবিধ মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ আমাদের ঘিরে রেখেছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য দীর্ঘ গবেষণার প্রয়োজন নেই। মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারলেই আমরাও বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে শুধু সমসাময়িক পর্যায়ই নয় একেবারে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে পারব। জাতির নানাবিধ কলঙ্ক মোচন করাও সম্ভব। এজন্য আইন-আদালত নয়, বিবেকের রক্তক্ষরণ প্রয়োজন।

আমার এক সহযোদ্ধার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আলাপ প্রসঙ্গে সে আমাকে একটি গল্প শোনায়। ‘ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ রবীশংকর এসেছিলেন ঢাকায়। ওই সময় ঢাকায় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। ফলে ঢাকার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ বারিন মজুমদারকে আয়োজকরা ইচ্ছাকৃতভাবে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাননি। বিষয়টি রবীশংকরের জানা ছিল না। মঞ্চে এক এক করে সবাই উপস্থিত। সেতার বাদক রবীশংকর এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখলেন, বিদগ্ধ বারিন মজুমদার মঞ্চ তো দূরের কথা অনুষ্ঠান স্থলেও নেই। তিনি কষ্ট পেলেন, প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ বারিন মজুমদারকে না পেয়ে। তিনি মনে করলেন, বারিন মজুমদারকে আমন্ত্রণ না করায় মজুমদারের কোনো সম্মানের ক্ষতি হয়নি বরং আয়োজকরা হীনমন্যতার পরিচয় দিয়েছেন এবং তার মতো একজন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে রবীশংকরকে খাটো করা হয়েছে। এবার সেতারবাদক রবীশংকর বেঁকে বসলেন, শর্ত দিলেন, বারিন মজুমদার মঞ্চে আসার পরই তিনি সেতারে হাত দেবেন। আয়োজকরা বেকায়দায়। বাধ্য হয়ে বারিন মজুমদারকে মঞ্চে নিয়ে আসেন। এরপর রবীশংকর বারিন মজুমদারকে কদমবুচি করে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। কী অপূর্ব! সম্মানবোধ। কী মহান সংস্কৃতি। অথচ আমরা ব্যক্তিগত আক্রোশ, অহমিকা, রাজনৈতিক হীনমন্যতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আমাদের সংস্কৃতিতে ঘুন ধরেছে। রাজনৈতিকভাবে আমরা এতই সংকীর্ণ যে একদল যা বলে করতে চায় তার সমালোচনা বা মূল্যায়ন নয়, কোমর বেধে বিরোধিতা করাই যেন আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি দেশের প্রতাপ ও প্রভাবশালী একটি একটি রাজনৈতিক দলের এক নেতা তো বলেই বসেছেন, ‘জাতি দুইবেলা দুমুঠো ভাত পাচ্ছে না।’ এই যদি হয় রাজনৈতিক ভাষ্য, জাতির প্রতি নেতাদের দায়বদ্ধতা তবে কিভাবে সাধারণ জনমানুষ নেতাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে? প্রসঙ্গে যাচ্ছি, অপচয় ব্যক্তি, মানুষকে অভাবী করে। অপচয়কারীরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়। অপচয় পৃথিবীর কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। একটি জাতির উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান শর্ত স্ব স্ব ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটানো এবং রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধভাবে শামিল হওয়া।

গত ১২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কুষ্টিয়া ভেড়ামারার ৪১০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন। ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিদ্যুৎ আমাদের মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবার সচেতন ও মিতব্যয়ী হওয়া উচিত। আমি যখন ঘর থেকে বের হই। নিজের হাতে সুইচ বন্ধ করি। এতে আমার সম্মান যায় না নিজের কাজ নিজে করার মধ্যেই সম্মান হানির কিছু নেই। আপনারা যখন ঘর থেকে বের হবেন তখনই সুইচ বন্ধ করে যান। আপনার যদি সুইচ বন্ধ করে রাখেন তাতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। এতে আপনাদেরই উপকার হবে। দেখবেন মাস শেষে বিদ্যুৎ বিল কম আসছে। এক ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে খরচ হয়, আমরা আপনাদের কাছ থেকে সে দাম নেই না। বিদ্যুৎ খাতে আমরা ভর্তুকি দেই। সবচেয়ে অনেক কম দামে আপনারা বিদ্যুৎ পান।’ প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই আহবানকে ঘিরে আমরা মিতব্যয়ী হওয়ার সংস্কৃতির অনুশীলন অবশ্যই করতে পারি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist