নিতাই চন্দ্র রায়

  ১২ এপ্রিল, ২০১৮

পর্যালোচনা

দেশ অর্থনীতির চালিকাশক্তি

আগ্রহ ও চেষ্টা থাকলে একটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। চাকরির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী হওয়ার একটি ভালো জায়গা হলো এসএমই খাত। এসএমই খাত আমাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ শিল্পই ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের অন্তর্ভুক্ত। জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। এসএমই খাত শ্রমঘন ও স্বল্প পুঁজিনির্ভর হওয়ায় এ খাতের মাধ্যমে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগে অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সুরক্ষার মাধ্যমে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ‘জাতীয় শিল্পনীতি-২০১৬’-তে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে শিল্প উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বর্তমান সরকারের গৃহীত কর্মসূচির ফলে দেশব্যাপী টেকসই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের দ্রুত প্রসার ঘটেছে। উদ্যোক্তাবান্ধব নীতির কারণে প্রতিনিয়ত নারীরা ব্যবসায় মনোনিবেশ করছে। ফলে দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির অনেক সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।

দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পাঁচ দিনব্যাপী ষষ্ঠ ‘জাতীয় এসএমই মেলা-২০১৮’-এর উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির লিখিত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে জেলায় এবং উপজেলায় এসএমই পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এ পরামর্শ কেন্দ্রগুলো এসএমই শিল্প প্রসারে ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টার হিসেবে কাজ করবে। উদ্যোক্তারা ব্যবসা স্থাপন থেকে শুরু করে ব্যবসা সম্প্রসারণ, ব্যবসায়িক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পরামর্শক সেবা ইত্যাদি এ ওয়ানস্টপ সেন্টার থেকে গ্রহণ করতে পারবেন। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে।’

বাংলাদেশের কুটিরশিল্পের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। একসময় এ দেশে তৈরি হতো বিখ্যাত মসলিন বস্ত্র। মসলিনের বিলুপ্তি ঘটলেও ঐতিহ্যবাহী জামদানি, নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী এখনো বহন করছে কুটিরশিল্পের ঐতিহ্য। দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে এখন নীরব বিপ্লব ঘটেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। পোলটিশিল্প থেকে শুরু করে নানা ধরনের খামার, হস্তশিল্প, প্যাকেজ শিল্প ইত্যাদির বিকাশের মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে এ শিল্প সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশীয় প্রযুক্তির ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বদলে গেছে অর্থনীতির দৃশ্যপট। বাংলাদেশে তৈরি মেশিনারিজ এখন চীন-ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিচ্ছে। কিছুদিন আগেও অতি প্রয়োজনীয় যেসব যন্ত্রপাতি- মেশিনারিজ ছিল শতভাগ আমদানিনির্ভর সেসব আজ এখানে তৈরি হয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ যে আজ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, এর পেছনে এ খাতের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছে ঢাকার ধোলাই খালের পার্টস ও মেশিনারিজ শিল্প। কেরানিগঞ্জের জিনজিরা বহুমুখী শিল্পাঞ্চল ছাড়াও অনেক স্থানে আমাদের মনোযোগের আড়ালে গড়ে উঠেছে এক একটি যুগান্তরকারী শিল্প কারখানা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এসব হালকা ও মাঝারি শিল্পে আরো বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবে। প্রতি বছর শুধু এসএমই খাতেই কমপক্ষে ১০ লাখ বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে, নারী উদ্যোক্তার সৃষ্টি হবেÑএটাই সবার প্রত্যাশা।

শুধু রাজধানীর আশপাশের এলাকায় নয়, ঢাকার বাইরে বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাট এবং যশোরেও গড়ে উঠছে ক্ষুদ্র মেশিনারিজ শিল্পের পল্লী। ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্পে ব্যতিক্রমধর্মী উদ্ভাবনের মাধ্যমে কয়েক যুগ ধরেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে জিনজিরা। এখানকার ঝুপরি বস্তির অজস্র কারখানায় খুদে ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি হাজারো পণ্যসামগ্রীর কদর রয়েছে সর্বত্র। দেশ-বিদেশে ‘মেড ইন জিনজিরা’ হিসেবে পরিচিতি আছে। রাজধানীতে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষা জিনজিরা-শুভাড্যা থেকে শুরু করে কেরানীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়েই এ শিল্পের অভাবনীয় বিস্তার। গোটা এলাকায় চলছে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। গড়ে উঠেছে দুই হাজারের বেশি ক্ষুদ্র হালকা শিল্প কারখানা। ১২ লাখ কারিগর-শ্রমিকের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে সম্ভাবনার আর এক বাংলাদেশ। সুঁই, ব্লেড, আলপিন, নাটবল্টু, রেল-বিমানের যন্ত্রাংশ, ফ্লাক্স ও মোবাইল ফোন সেট থেকে শুরু করে সমুদ্রগামী জাহাজ পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে এখানে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছরের পর বছর গবেষণা শেষে জাপান, কোরিয়া ও চীন যেসব সামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত করে, সেসব জিনিস একনজর পরখ করেই হুবহু তৈরি হতে থাকে জিনজিরায়। সেখানকার অভাবনীয় মেধার খুদে কাবিগরদের দক্ষতা অবাক করে দিচ্ছে। বর্তমানে জিনজিরাকেন্দ্রিক খুদে কারখানাগুলো থেকে বছরে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদিত অনেক পণ্যই দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রফতানি হচ্ছে বিদেশে। জিনজিরাকে অনুসরণ করে দেশজুড়ে এ রকম ৪০ হাজারেরও বেশি শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি সূত্র জানায়, দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের হালকা প্রকৌশল শিল্পে বছরে টার্নওভার ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হচ্ছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ছয় লাখ কর্মীসহ পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ৬০ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা।

উত্তরাঞ্চলে প্রাণকেন্দ্র বগুড়ায় কৃষি যন্ত্রাংশ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ঘটে গেছে নীরব বিপ্লব। বিসিক শিল্প নগরীসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কৃষিযন্ত্রপাতি তৈরির ৭ শতাধিক কলকারখানা। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এসব কলকারখানা প্রতি বছর দেড় হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি উৎপাদন করে জাতীয় অর্থনীতিতে কয়েক হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় করছে। স্থানীয় কৃষকের চাহিদা মেটানো এসব কৃষি যন্ত্রপাতি ভারতসহ অন্যান্য দেশেও রফতানি হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে রংপুরেও প্রায় দেড় লাখ মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছেন। মাত্র ২০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা শিল্প নগরীতে ২৭টি ক্ষুদ্র কারখানা স্থাপিত হয়েছে। রংপুরের তৈরি শতরঞ্জি ও বেনারসি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে জয়পুরহাটে ক্ষুদ্রশিল্পের বেশ প্রসার ঘটেছে। বিশেষ করে পোলট্রিশিল্পের বিকাশ বেশ লক্ষণীয়। গত পাঁচ বছরে ছোট-বড় ৩২টি মুরগির বাচ্চা ফুটানো হ্যাচারি, ১১টি পোলট্রি ফিড মিল ও ৬ হাজার মুরগির খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যশোর শহরের মনিহার সিনেমা হলের সামনে থেকে শুরু করে যশোর-খুলনা মহাসড়ক ধরে দুই পাশে অসংখ্য অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ গড়ে উঠেছে। যশোরে এ রকম ছোট-বড় তিন হাজারের মতো ওয়ার্কশপে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে প্রতি মাসে সাড়ে চার শ বাস ও ট্রাকের বডি নির্মাণ হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ শিল্পে যশোরে লেনদেন হচ্ছে বছরে ৬০০ কোটি টাকার বেশি। লালবাগ রহমতগঞ্জ এলাকার বেশ কয়েকটি প্রসাধনী কারখানা শতভাগ নারী কর্মী দ্বারা পরিচালিত। খুব অল্প সময়েই নারী কর্মীরা প্রসাধনী প্রস্তুত, প্যাকিং ও আনুষঙ্গিক কর্মকা- করতে সক্ষম। এ ছাড়া তারা কাজের প্রতি যতেষ্ট আন্তরিক।

এসএমই খাতের উন্নয়নে ‘ফ্যাক্টরিং ফাইন্যান্স’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশগুলোয় ব্যবসার খরচ কমাতে এর ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে এখন অল্প পরিসরে অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্টরিং ব্যবস্থা চালু আছে। অর্থ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পদ্ধতি এসএমই উদ্যাক্তারা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে আরো নতুন নতুন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এটি ব্যবসায়ীদের হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করবে এবং ব্যয় কমাবে।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

netairoy18@yahoo

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist