সাধন সরকার
পর্যবেক্ষণ
পরিবেশ রক্ষায় পশ্চাৎযাত্রা
সম্প্রতি বাংলাদেশ ‘উন্নয়নশীল’ দেশের তকমা পেয়েছে। একটি দেশে উন্নয়ন-অগ্রগতি হবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও সমান গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। কেননা চারপাশের পরিবেশকে উপেক্ষা করে শুধু উন্নয়নের জয়গান গাইলে সে উন্নয়ন কতটুকু টেকসই ও জনবান্ধব হবে তা প্রশ্নের দাবি রাখে। সম্প্রতি প্রকাশিত (গত ২৩ জানুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্সের’ (ইপিআই) প্রতিবেদনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে সংস্থাটি ১৮০টি দেশ সামগ্রিকভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় কী ধরনের ভূমিকা রেখেছে তার সামগ্রিক তথ্য নিয়ে এই সূচক তৈরি করেছে। বাংলাদেশ যথারীতি ১৭৯তম স্থানে অবস্থান করছে। ২০০৬ সালে সংস্থাটির সর্বপ্রথম তৈরি সূচকটিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫তম। ২০১৬ সালে অবস্থান ছিল ১৭৩তম। এ কথা স্পষ্ট, ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পরিবেশ ভয়াবহ দূষণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নিচের সারিতে অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছেÑবায়ুর মান উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও গ্রিনহাউস গ্যাস কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এর আগে ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটের এক গবেষণায় উঠে আসে, দেশে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে দূষণে। প্রতিবেদনে বলা হয় বায়ু, পানি ও মাটির দূষণে এসব মৃত্যু ঘটছে।
সত্যিই বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে বায়ুদূষণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রাজধানী ঢাকা শহরে বায়ুদূষণ তো চলাফেরার নিত্যসঙ্গী। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের’ যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭’ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা। ২০১৬ সালে এ তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয়। বায়ুতে যেসব ক্ষতির উপাদান আছে তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে ‘পিএম ২.৫’। এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সহজেই শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ ও হৃদরোগের পরিমাণ বাড়ায়। ঢাকার বাতাসে এই ক্ষতিকর উপাদানটির পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের সরাসরি মৃত্যু হয়। এক কথায়, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিঃশ্বাসে দূষণ নিয়ে বেড়ে উঠছে। ফলে তাদের দেহে অল্প বয়স থেকেই বায়ুদূষণে সৃষ্ট নানা রোগ নীরবে বাসা বাঁধছে। ঢাকা শহরে বিভিন্ন নির্মাণকাজের ফলে প্রচুর ধুলা ও ধোঁয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ এই ধুলাবালি। রোগজীবাণুমিশ্রিত ধুলাবালি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে নানা রোগব্যাধি সৃষ্টি করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোর, কর্মস্থলে যাওয়া নারী-পুরুষ এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষরা প্রতিদিন এই অবর্ণনীয় ধুলাদূষণের শিকার হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় ধুলাদূষণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে তিন গুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ধুলা ও বায়ুদূষণের জন্য ঢাকাবাসীর বছরে ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হচ্ছে।
দেশে প্রতিনিয়ত পরিবেশ আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশে আইন ও প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। তার পরও যদি পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দিনের পর দিন পিছিয়ে যেতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে পরিবেশ রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট আন্তরিক নয়। পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে আইন ও নীতিমালার শেষ নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। আর এ কারণেই বাংলাদেশ পরিবেশ রক্ষায় বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দূষণজনিত মৃত্যু অচিরেই অন্যসব মৃত্যুর কারণকে ছাপিয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা বহু আগেই প্রমাণ করেছেন, যদি বায়ুদূষণে ক্ষতিকর ধুলাবালি দেহের ভেতরে প্রবেশ না করত, তাহলে মানুষ আরো বেশি দীর্ঘায়ু হতো। পরিবেশদূষণে মানুষের গড় আয়ু কমে যায়। দূষণের কারণে শুধু মানুষের কর্মক্ষমতা নয়, সামগ্রিক জীবনের ওপরও হুমকি তৈরি হয়। রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে এ দেশের নীতিনির্ধারকদের যতটা আগ্রহ চোখে পড়ে পরিবেশ রক্ষা নিয়ে ততটা চোখে পড়ে না। পরিবেশ রক্ষার মতো বিষয়কে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র ও সুশাসন যে কার্যকর হতে পারে নাÑএটা ভাবতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০১২ সালের এক তথ্যে বলা হয়েছে, পরিবেশদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি লাখে ১৭৯টি শিশুর মৃত্যু হয়। আর বিশ্বে বছরে ১৭ লাখ শিশু মারা যায়। কী ভয়াবহ কথা ও সতর্কবার্তা! বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উপাত্তের ওপর ভিত্তি যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২০১৬ সালের এক তথ্যে বলা হয়, বাতাসে ক্ষতিকর ধূলিকণার দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজশাহী শহর বিশ্বে সর্বাধিক সাফল্য অর্জন করেছে। রাজশাহী শহর যদি পারে তাহলে অন্যান্য শহর পারবে না কেন? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা, যেকোনো কর্মকা-ে পরিবেশের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় নেওয়া ও জনগণের মধ্যে পরিবেশবান্ধব সচেতনতা তৈরি করা গেলে পরিবেশদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব। পরিবেশ অধিদফতরের এক তথ্যে উঠে এসেছে, ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী আশপাশের ইটভাটা। দেশের বেশির ভাগ ইটভাটায় দূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রযুক্তি নেই বললেই চলে। যাহোক, যেকোনো উন্নয়ন কর্মকা-ে পরিবেশগত সমীক্ষা নিরূপম (ইআইএ) বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং তার ফলাফল আমলে নিতে হবে। পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সচেতনতা ও পরিবেশবিধ্বংসী কার্যকলাপ বন্ধে সরকার, সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ ও জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"