জি. কে. সাদিক

  ১১ এপ্রিল, ২০১৮

আন্তর্জাতিক

সন্ত্রাসীর উৎস খোঁজা দরকার

প্রথমেই বলে রাখি, কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের গুণকীর্তন করা লেখার বিষয় না। কোন সংগঠন সন্ত্রাসী আর কোনটা নয় সে তত্ত্বও উদ্ঘাটন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় এবং সেটা আমার লেখার উদ্দেশ্যও নয়। কারণ প্রত্যেক স্বাধীনতাকামী ও মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াইরত ব্যক্তিই তার বিরোধী পক্ষের কাছে সন্ত্রাসী ও অরাজকতা সৃষ্টিকারী অন্তত বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার পরিম-লে। পশ্চিমারা যাকে হিরো বানায়, প্রয়োজনে তাকেই ভিলেন বানিয়ে ফাঁসি দেয়। আর তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলো ‘সাদা হাতি’। হিরোকে ভিলেন আর ভিলেনকে হিরো বানাতে যাদের পাঁচ মিনিটের ভিডিও শুটিংই যথেষ্ট। গত ২ এপ্রিল আফগানিস্তানের কুন্দুজ প্রদেশের দাস্তি আর্চি জেলার একটি হাফিজিয়া মাদরাসায় আফগান বিমানবাহিনীর হামলায় ১১ থেকে ১২ বছরের ১৫০ জন হাফেজের মৃত্যুর ঘটান দিয়ে শুরু করছি। যাদের একজনও তালেবান ছিল না। শিক্ষাজীবন শেষে (কোরআন হেফজ তথা মুখস্থ) সনদ ও পাগড়ি পরারত অবস্থায় জীবনের শেষকৃত্য হয় ১৫০ জন হাফেজে কোরআনের। যে অনুষ্ঠান হচ্ছিল সেটা তালেবানদের যুদ্ধের প্রস্তুতি মিটিং ছিল না। সেখানে কিশোর বয়সের কিছু ছেলেদের শিক্ষার সনদ প্রদান অনুষ্ঠান ছিল আর সেখানেই বিমান হামলা হলো তালেবানদের অস্তানা সন্দেহে। সভ্য পৃথিবীর ঘাড়ে এখন এ ঘটনার বিচার ভার। এখন এ ঘটনাকে কীভাবে দেখবে এবং কোন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করবে?

তালেবান দমনের নামে আফগানিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা এটা প্রথম নয়। অনেক ঘটনার মধ্যে এটা একটা। এর আগেও অনেকবার এমন স্থাপনাগুলোয় হামলা হয়েছে, যা তালেবানদের আস্তানা বা ‘মিটিং প্লেস’ নয়। এমন মানুষের ওপর হয়েছে যারা তালেবান বা কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয় বা সন্ত্রাসীও না। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ফ্রান্সের এনজিও সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত কুন্দুজের ডক্টরস উইদাউট বার্ডাসের হাসপাতালে মার্কিন বোমারু বিমান এসি-১৩০ থেকে বোমা ফেলে চিকিৎসকসহ ৪২ জনকে হত্যা করা হয়। যাদের একজনও তালেবান ছিল না। এর আগে ২০১১ সালের ১১ মার্চে এক মার্কিন সেনার গুলিতে ১৬ জন নিরীহ আফগানী প্রাণ হারায়। হত্যাকারী সৈনিকের লঘু শাস্তি ও ন্যাটো জোট এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে দায় সাড়ে। ২০১৬ সালে ৩ নভেম্বর কুন্দুজে মার্কিন বিমান হামলায় ৩৩ বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায়। সেবারও ন্যাটো জোট গতানুগতিক দুঃখ প্রকাশ ও সমবেদনা জানায়। ২০১১ সালে কুনারে ন্যাটোবাহিনীর হামলায় ৬৫ জন বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায় যার মধ্যে ৪০ জনই শিশু। ২০১৩ সালের জুন মাসে পূর্বাঞ্চলের পাকশিয়া প্রদেশের একটি বাজারে মার্কিন বিমান হামলায় ১০ স্কুল শিক্ষার্থী প্রাণ হারায়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন হামলায় প্রাণ হারায় ছয় শিশু। আর প্রত্যেক বারের মতো দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয় ন্যাটো। বার্তা সংস্থা এএফপির তথ্য মতে, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালেবান দমনের জন্য চালানো হামলায় নিহতদের মধ্যে ৬০ ভাগ সাধারণ মানুষ। আর এর মধ্যে ২৭ শতাংশ মানুষ প্রাণ হারায় ন্যাটো জোটের হামলায়। উপরোল্লিখিত নিহতদের কেউই তালেবান বা সন্ত্রাসী না।

আমি যে হামলাগুলোর কথা বললাম এর বাইরেও আরো অনেক বেসামরিক মানুষ হত্যার তথ্য আছে। সব হত্যার পরেই গতানুগতিক দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতগুলো সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য একটা দুঃখ প্রকাশের বিবৃতি? সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য কতটা সে দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ইরাকের কাছে বিপুল বিধ্বংসী অস্ত্রের দোহাই দিয়ে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ চালায় আমেরিকা ও ব্রিটেন। সে যুদ্ধে তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। যার মধ্যে ৫০ হাজার শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। বুশ-টনি ব্লেয়ার টিভি সাক্ষাৎকারে দুঃখ প্রকাশ করেই তিন লাখ মানুষের জীবনের মূল্য শোধ করেছেন। ৫০ হাজার শিশুর মধ্যে কতজন সন্ত্রাসী ছিল? একজনও না। তাহলে কেন তাদের হত্যা করা হলো? প্রত্যেকটা হামলার ঘটনাই ভুলবশত হয়েছে। এবারও আফগানিস্তানে মাদরাসায় যে হামলা করেছে, সেটাও ভুলবশত। হামলার পর আফগান সিনেটর বিবৃতি দিয়ে ভুলের কথা জানিয়েছেন।

সন্ত্রাস দমনের জন্য দুদেশের মধ্যে দৃঢ় অঙ্গীকার ও চুক্তিনামা হয়। সময়ের দাবি অনুযায়ী এমন চুক্তি হওয়া দরকার, কেন সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসী হয়, কেন তারা সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়, তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস, আল শাবাব, বোকো হারামো, ভারতের মাওবাদী, তামিলে এলটিটি, কাশ্মীরে হিজবুল মুজাহেদিন, ফিলিস্তিনে হামাসÑএসব দল কেন তৈরি হলো এবং কারা সৃষ্টির ইন্ধন দেয় এ উৎসগুলো খোঁজা। এত হামলা আর এত সন্ত্রাসীর মৃত্যু কিন্তু তার পরও দশকের পর দশক রক্তপাত চলছে সন্ত্রাসী এবং সভ্যতাবাদী শান্তিকামীদের মধ্যে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের বিনাশ হচ্ছে না কেন? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে ম্যানবুকার জয়ী ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য ব্রোকেন রিপাবলিক’ বইটা পড়তে বলব। কেন সন্ত্রাস দমন হয় না, সন্ত্রাস দমন অভিযান কেন ব্যর্থ হয় বরং সন্ত্রাসের প্রজনন কেন বৃদ্ধি পায়, এসব প্রশ্নের জুঁতসই উত্তর বইটা পড়তে পড়তে প্রমাণসহ দেওয়া আছে। যেখানে লেখিকা মাওবাদীদের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে তুলে ধরছেন কেন মাওবাদীরা সন্ত্রাস করে। এ রকম আরো কিছু বই লেখা দরকার সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, নাইজেরিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানের কেন সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাস করছে তার উত্তর দিয়ে। টুইন টাওয়ারে বিমান হামলায় তিন হাজার মানুষের প্রাণহানির জন্য যদি আমেরিকা আফগানিস্তানের স্বাধীন ভূমিতে প্রতিশোধ নিতে হামলা চালাতে পারে। শত শত তালেবান, আল-কায়েদাকে হত্যা করতে পারে। তাহলে তিন লাখ নিরীহ মানুষ হত্যার প্রতিবাদে তিন লাখ মানুষের স্বজনরাও সন্ত্রাসী হতে পারে। সিরিয়াতে আজ যারা বিনা কারণে প্রাণ হারাচ্ছে এ কারণেই হয়তো আগামী দিনে এই নিহত মানুষের স্বজনরা সন্ত্রাসী হতে পারে। সন্ত্রাসী হতে পারে নিহত ১৫০ জন হাফেজের স্বজনরা। শান্তিকামীরা যাদের সন্ত্রাসী বলছে, তাদের কাছে আবার শান্তিকামীরা সন্ত্রাসী। কারণ সন্ত্রাসীরা নিজেদের ভূমিকে রক্ষার জন্য লড়ছে বা নিজেদের মতাদর্শ নিজের ভূমিতে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে। যেমনটা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে গণতন্ত্রবাদীরা বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছে, প্রয়োজনে হামলা করছে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবীরা নানা জায়গায় যেমনভাবে বিপ্লব করেছে এবং করছে। গণজাগরণের নামে স্বাধীন, সার্বভৌম ও আর্থিক সচ্ছল ও শান্তিপূর্ণ দেশে রক্তপাত ঘটানো হচ্ছে। যদি তথাকথিত শান্তিকামীদের রক্তপাত শান্তির জন্য হয় তাহলে মাওবাদীদের রক্তপাত কেন সন্ত্রাস হবে? যারা নিজেদের ভূমি রক্ষার জন্য দশকের পর দশক ধরে ভারতে কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। কাশ্মীরিদের কেন সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে? যারা মাতৃভূমির স্বাধীনতার দাবিতে জীবন দিচ্ছে? স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিদের কেন সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে? এ প্রশ্ন উঠতেই পারে এবং উঠছে। আর ঠিক সে কারণেই এখন সময় সন্ত্রাসের উৎস খোঁজার, কেন সন্ত্রাস প্রজনন বন্ধ হচ্ছে না সে বিষয়ে ভাবার সময়। আর আমরা যাদের সন্ত্রাসী বলছি, সত্যিই কি তারা সন্ত্রাসী? না কি শান্তিকামীরা অথবা তারা যাদের সন্ত্রাসী বানিয়েছে তারা! বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist