আবু আফিয়া আহমদ

  ০৯ এপ্রিল, ২০১৮

মতামত

কোথায় সেই প্রকৃত মুসলমান

কে মুসলমান আর কে মুসলমান নয়Ñএ নিয়ে দেখা যায় এক ধরনের আলেম-ওলামা বিভিন্ন স্থানে মহাসম্মেলনের আহ্বান করেন আর শেষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধা করেন না তারা। প্রকৃত মুসলমান হিসেবে সবাই নিজেকে দাবি করেন আর যে দলের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত, সেই ফেরকাকেই একমাত্র মুক্তিপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করেন। আমরা দেখতে পাই, মুসলমানদের ভেতরই অনেক ফেরকা রয়েছে, তারা সবাই নিজদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে থাকেন। সবাই শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রকৃত উম্মত হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন। অথচ যে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বনবী রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মোহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে এসেছিলেন, সেই শিক্ষার অনুসরণ করে থাকেন এমন কোনো ফেরকা রয়েছে? মহানবী (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষা মোতাবেক যদি কোনো ফেরকা তাদের কার্যক্রম চালায়, তাহলে তাদেরই প্রকৃত মুসলমান বলা যেতে পারে। শতধাবিভক্ত মুসলমান ফেরকাগুলোর মধ্যে আজ আমরা দেখতে পাই শুধু নামেই মুসলমান, কার্যত মুসলমানের কোনো লক্ষণ তাদের মধ্যে প্রকাশিত হয় না। এমন কি অপকর্ম বাদ আছে, যা তাদের মাধ্যমে সংঘটিত হচ্ছে না? মুসলমান হয়ে সব ধরনের অপকর্ম করে যাচ্ছে, কোরআন-হাদিসের শিক্ষা ভুলে গিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করছে।

অথচ ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম আর এ শান্তির ধর্মের অনুসারী হয়েও সমাজে কতই না অশান্তি সৃষ্টি করছে। শত ফেরকার মধ্যে একটি মাত্র ফেরকা জান্নাতি বা মুক্তিপ্রাপ্ত হবে ঠিকই, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দলটি কারা? এই মুক্তিপ্রাপ্ত দল কি তারা, যারা মানুষকে কষ্ট দেয়? রাষ্ট্রীয়ভাবে কাউকে অমুসলমানের দাবি জানিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে? যারা অপর দলের মসজিদ ও সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করে নেয় তারা? না যারা বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে, তারা মুক্তিপ্রাপ্ত? মোটেও এরা মুক্তিপ্রাপ্ত হতে পারে না। কেননা মুক্তিপ্রাপ্ত ফেরকা সম্পর্কে হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলী ৭২ ফেরকায় বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ ফেরকায় বিভক্ত হবে। তাদের প্রত্যেকেই জাহান্নামে যাবে কেবল মাত্র একটি ফেরকা ছাড়া। সাহাবারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেই একটি ফেরকা কোনটি? তিনি (সা.) বললেন, আমি এবং আমার সাহাবারা যে পথে আছি, সেই পথে যেই ফেরকা থাকবে।’ (তিরমিযি, কিতাবুল ইমান)। হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ হয়েছে। ইসলাম আজ অনেক দলে বিভক্ত হয়েছে আর প্রত্যেক দলের দাবি তারাই কেবল জান্নাতি এবং মুক্তিপ্রাপ্ত দল। আর প্রত্যেক দলই অন্য দলকে মিথ্যা মনে করে কাফের আখ্যা দিয়ে রেখেছে। এভাবে দেখা যায় সব দলই কাফের হয়ে বসে আছে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, সবাই যদি কাফের হয়ে থাকে, তাহলে মুসলমান কে? ইতিহাস পাঠে জানা যায়, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মোহাদ্দেছ দেহলবি এ দেশে সর্বপ্রথম ফার্সিতে কোরআন অনুবাদ করে তৎকালীন মৌলবাদ কর্তৃক কুফরি ফতোয়ায় ভূষিত হয়েছিলেন। আমরা এখন দেখব কোন দল কাকে কাফের বা অমুসলমান বলে আখ্যা দিয়ে রেখেছেন, তার কয়েকটি নমুনা।

বেরেলভি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দেওবন্দির ফতোয়া : যে ব্যক্তি আল্লাহ জাল্লা শানুহু ছাড়া অন্য কাউকে আলেমুল গায়েব বলে সাব্যস্ত করে আর আল্লাহর সমপর্যায়ে অন্য কারো জ্ঞান আছে বলে বিশ্বাস করে, সে নিঃসন্দেহে কাফের। তার ইমামতি, তার সঙ্গে মেলামেশা, তার প্রতি সৌহার্দ্য প্রকাশ সব হারাম। (আল্লামা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহি প্রণিত ফতোয়ায়ে রশিদিয়া কামেল : পৃষ্ঠা ৩২, প্রকাশক মুহাম্মদ সাইদ, ১৮৪৩-১৮৮৪)

শিয়াদের বিরুদ্ধে দেওবন্দি আলেমদের ফতোয়া : শিয়ারা কেবল মুরতাদ, কাফের আর ইসলামবহির্ভূতই নয় বরং তারা ইসলাম এবং মুসলমানদের এমন শত্রু, যা অন্যান্য সম্প্রদায়ে কম পাওয়া যাবে। মুসলমানদের এ ধরনের লোকদের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করা উচিত। বিশেষ করে বিয়েশাদির ব্যাপারে। (মৌলানা মুহাম্মদ আবদুশ শাকুর লাক্ষেèৗ থেকে প্রকাশিত ফতোয়া ১৩৪৮ হিজরি সন)

আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ফতোয়া : সত্তরজন দেওবন্দি আলেম কর্তৃক স্বাক্ষরিত ফতোয়া জারি করে তাতে আহলে হাদিস সম্প্রদায়কে কাফের ফতোয়া দেয় এবং বলে যে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, তাদের মসজিদে প্রবেশ করতে দেওয়া শরিয়ত অনুযায়ী নিষিদ্ধ এবং ধর্মের জন্য ফেতনা ও ভয়ের কারণ। (বিজ্ঞাপন, আবু আলাই ইলেকট্রিক প্রেস, আগ্রা থেকে প্রকাশিত)।

জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে ফতোয়া : মওদুদীর লেখা বইপুস্তকের উদ্ধৃতি দেখে প্রতীয়মান হয়, সমস্ত ইমাম এবং সম্মানিত সব নবীর শান ও মর্যাদার বিরুদ্ধে ধৃষ্টতা ও অবমাননায় ভরপুর। তিনি যে নিজে পথভ্রষ্ট ও অপরকে পথভ্রষ্টকারী এতে কোনো সন্দেহ নেই। হুজুর (সা.) বলেছেন, প্রকৃত দাজ্জালের আগমনের আগে আরো ৩০ জন দাজ্জাল জন্ম নেবে। যারা আসল দাজ্জালের পথ সুগম করবে। আমার জ্ঞান ও ধারণা মতে সেই ৩০ দাজ্জালের মধ্যে একজন হলো মওদুদী। (মৌলানা মুহাম্মদ সাদেক, মোহতামিম, মাদরাসা মাজহারুল উলুম, করাচি প্রদত্ব ফতোয়া, ২৮ জিলহজ ১৩৭১ হিজরি)।

বর্তমান যুগের মুসলমানদের সম্পর্কে মওদুদীর মন্তব্য : আহলে হাদিস, হানাফি, দেওবন্দি, বেরেলবি, শিয়া সুন্নি প্রভৃতি ফেরকা জাহেলিয়াতের উৎপাদন। (খোতবা সপ্তম সংস্করণ-৭৬ পৃষ্ঠা) তিনি জন্মগত মুসলমানদের আহলে কিতাব বা ইহুদি খ্রিস্টানের অনুরূপ বলে উল্লেখ করেছেন। (সিয়ামি কশমকশ, তৃতীয় খ-, ১৩৩ পৃষ্ঠা) তিনি তার জামায়াত থেকে বের হয়ে যাওয়ার অর্থ জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া বলেছেন। (রোয়েদাদ জামায়াতে ইসলামী, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৮)।

জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সুন্নি আলেমদের ফতোয়া : মওদুদীর জামায়াত একটি গোমরাহ জামায়াত। এদের আকায়েদ আহলে সুন্নত জামায়াত ও কোরআনের এবং হাদিসের খেলাফ। (মৌলানা হোসেন আহমদ মদনি) আরো বলা হয়েছে, মওদুদীপন্থিদের পেছনে নামাজ পড়া মাকরুহ তাহরিমা। (মৌলানা মাহদী হাছান, মুফতি দেওবন্দ, এ ব্যাপরে আরো দুই হাজার আলেমের দস্তখত আছে, দেখুন মওদুদী জামায়াতের স্বরূপ পুস্তিকায়)।

মোকাল্লেদদের বিরুদ্ধে আহলে হাদিসদের ফতোয়া : চারি ইমামের অনুসারী চারি তরিকার হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি, হাম্বলি এবং চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নকশবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া প্রভৃতি লোক মুশরেক ও কাফের। (মজমুয়া ফতোয়া, পৃষ্ঠা ৫৪-৫৫)।

সুন্নিদের বিরুদ্ধে ফতোয়া : আহমদ রেজা খান বেরেলভি এবং তার অনুচর সবাই কাফের। যে তাদের কাফের বলবে না সেও কাফের, যে তাদের কাফের বলে সন্দেহ করে সেও কাফের। (রদ্দুত তফসির, পৃষ্ঠা ১১)। আরো উল্লেখ আছে, গয়ের মোকাল্লেদের চিহ্ন হলো জোরে আমিন বলা, রাফেইয়াদাইন করা, নামাজে বুকের ওপর হাত বাঁধা, ইমামদের পেছনে আলহামদু পড়া, এহেন ব্যক্তিরা সুন্নত জামায়াত থেকে খারিজ এবং রাফেজি প্রভৃতি গোমরাহ ফেরকার সমতুল্য। (জামেউশ শাওয়াহিদ ফি ইখরাজিল ওহাতীনা আনিল মসজিদ)।

আহমদিদের বিরুদ্ধে ফতোয়া : আল্লামা লুধিয়ানি বলেন, আহমদিয়া জামাত মুরতাদ সুতরাং তিন দিনের সুযোগ দিয়ে তাদের হত্যার অবকাশ আছে। আহমদিয়া জামাত যিন্দিক। সুতরাং কোনো সুযোগ না দিয়েই তাদের হত্যা করা যেতে পারে। (পুস্তক-কাদিয়ানি এবং অন্য কাফিরদের মধ্যে পার্থক্য)।

দেখা যায়, প্রায় সব ফেরকার বিরুদ্ধেই কুফরি ফতোয়ার সার্টিফিকেট রয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়, বর্তমান আর কেউ প্রকৃত মুসলমান নেই, নাউজুবিল্লাহ। সবাই যদি কাফের হয়ে থাকে তাহলে কে মুসলমান এবং মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি যার কথা হজরত রাসুল করিম (সা.) উল্লেখ করেছেন। যতই ফতোয়া দিক না কেন অবশ্যই প্রকৃত ইসলামের অনুসারী আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে, কারণ ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম (সুরা আলে ইমরান)। এখন আমাদের নিজেদের দায়িত্ব, কোন দলটি সঠিক তা বের করা। কারা পবিত্র কোরআন ও হাদিস মোতাবেক পরিচালিত, কাদের মাঝে হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর আদর্শ আজও প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, কোন দলে তার সাহাবিদের আদর্শ পাওয়া যায়, কোন দলের মধ্যে একক ঐশী নেতা বা খলিফা বিদ্যমান রয়েছে, যারা তার কথার ওপর পরিপূর্ণ আমল করে, কোন ফেরকার মাঝে বায়তুল মাল রয়েছে, কোন ফেরকার অনুসারীরা সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে না, কারা অর্থের বিনিময়ে ওয়াজ মাহফিল করে না। অতএব অযথা কোনো ফেরকাকে অমুসলমান আখ্যায়িত করার পূর্বে আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে তাদের মাঝে এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান কি না? এই বৈশিষ্ট্যগুলো যদি আজ কোন ফেরকা বা ইসলামী দলের মাঝে পাওয়া যায়, তাহলে তাদেরই প্রকৃত ইসলামী দল বলা যেতে পারে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে প্রকৃত ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়ার সৌভাগ্য দান করুন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist