নুরউদ্দিন আহসান
মূল্যায়ণ
ভাষার শুদ্ধ ও সঠিক উচ্চারণ
এ বছরের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাস ইতোমধ্যে আমরা অতিক্রম করেছি। যে দুটি মাসের সঙ্গে আমাদের রয়েছে রক্তের ইতিহাস। রয়েছে বিয়োগান্ত আর অশ্রুঝরার হিসাব-নিকাশ। যেখানে রচিত হয়েছে বিরল মাইলফলক। প্রথমটি ভাষার জন্য। দ্বিতীয়টি, স্বাধীনভাবে মুক্ত পাখির মতো দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। একটি স্বাধীন ভূখ-ের জন্য। আর এই স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা বা উৎসহ আমরা প্রথম মাস থেকেই পেয়েছি। আর তা হলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে। যেখানে রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের মায়ের ভাষা, হৃদয়ের ভাষাকে অত্যাচারী জালিমের হাত থেকে রক্ষা করেছি। যা সষ্ট্রার দেওয়া প্রত্যেক জাতির জন্য বড় নিয়ামত। যা প্রত্যেক জাতির কাছে মহামূল্যবান। যা আত্মিক প্রশান্তির মেলবন্ধন হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। বিশেষ করে প্রবাসীদের কাছে। প্রতিটি মুহূর্তে যা তারা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে হাতের কাছে থাকা এ অমূল্য রতনকে আমরা তেমন মূল্যায়ন করি না। নানাভাবে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে উপস্থাপনা করি। যে কাজটা অধুনিকতার নামে নিজেকে ভিন্ন ভঙ্গিমায় উপস্থাপনা করতে হরহামেশা চালিয়ে যাচ্ছে কিছু মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। সবাই না। তবে অনেকেই করছে এ কাজটা, যা রেডিও বা টেলিভিশন খুললেই আমাদের কর্ণকুহরে তাদের ব্যঙ্গাত্মক ও অশুদ্ধ উচ্চারণ এসে হানা দেয়। আমরা বিব্রত হই।
আমরা মনে করি, যারা বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে উচ্চারণ না করে, ভিন্ন ভঙ্গিতে উপস্থাপনা করে, তারা শুধু ভাষা শহীদদের প্রতি অবমাননা করছে না। নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেও পদদলিত করছে। এটা নিজের মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে। নিজেকে নিজেই অপমানিত করছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক জাতিই তাদের ভাষাকে সঠিকভাবে উচ্চারণের পাশাপাশি নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখে। কেন আমরা বাংলার মাঝে ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলব। কেন আমরা হিন্দিকে এর মাঝে টেনে আনব? আমাদের কি সঠিক পঠনরীতি নেই? আজ যারা মিডিয়াতে কাজ করে, তাদের মানুষ বেশি অনুসরণ করে। এরা সবাই পারফর্মিং আর্টের সদস্য। বর্তমান সময়ে এখান থেকেই কিশোর ও তরুণরা বেছে নেয় তাদের অনুকরণীয় ব্যক্তিকে। তাদের আদর্শবান ব্যক্তি হয়ে ওঠে এরাই। এরা কীভাবে কথা বলে, তা অনুকরণ করাই হয়ে ওঠে তাদের জীবনের আদর্শ। ভাষা উচ্চারণের সঠিক পদ্ধতি। আদর্শবান ব্যক্তির ভুল আছে কি নাÑতা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করার সময় তাদের নেই। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তির, সঠিক ও শুদ্ধভাবে ভাষার ব্যবহার করাটা অতীব জরুরি।
লেনসন ম্যান্ডেলার মতে, ‘যখন আপনি কোনো ভাষায় কাউকে কিছু বলবেন, তা তার মস্তিষ্কে পৌঁছায়। সে তা বুঝতে পারে। কিন্তু যখন তার নিজের ভাষায় বলেন, তখন তা তার হৃদয়ে পৌঁছায়।’ তাই এই তরুণ প্রজন্ম যেন মায়ের ভাষাটার ভুল উচ্চারণ না শিখে প্রমিত উচ্চারণে ফিরে আসে। যেন আগামীর প্রজন্মের কাছে সঠিক ভাষা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। তাই মিডিয়া ব্যক্তিদের সঠিক ভাষা উচ্চারণরীতি অনুসরণ করে উপস্থাপনা করা তাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর ভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান থেকে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই উৎসাহিত হতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, এ ভাষা অন্য সব দেশের ভাষার মতো নয়। এর রয়েছে নিজেস্ব স্বকীয়তা। এর পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস, যা আজ বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়ে ইতিহাসের খাতায় নাম লিখিয়েছে। যে জন্য আমরা গর্ববোধ করি। যে কারণে অন্য কোনো ভাষা থেকে এর মর্যাদা কোনো অংশে কম নয়। বিশ্ববাসী আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পালন করছে আমাদের ভাষার, ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে। যার রয়েছে নিজস্ব ব্যাকরণরীতি, রয়েছে সঠিক পঠন পদ্ধতি, রয়েছে সঠিক উচ্চারণরীতি। সবকিছু থাকার পরও কেন আমরা ভিনদেশি ভাষাকে অনুসরণ করব? নিজের ভাষাকে ব্যঙ্গ করে উপস্থাপন করার অর্থ, তাকে অপমান করা। আজ আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার জন্য দাবি তুলেছি। আর তা রাখার যৌক্তিকতাও রয়েছে। আমরা আশান্বিত, অচিরেই তা হবে। এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা যদি নিজেরাই সঠিকভাবে ভাষাকে ব্যবহার করতে না পারি। তাহলে বিশ্বদরবারে কী করে সম্ভব। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিনিয়তই হারিয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা। একই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি অংশ। বিষয়টা আমাদের জন্য বিপৎসংকেতই বটে। কেননা আমাদের এই অশুদ্ধ উচ্চারণ, ভাষার নিজস্বতা বজায় না রেখে ভাষাকে ব্যবহার করার অর্থ হলো অচিরেই আমরা এই হারিয়ে যাওয়ার কাতারে গিয়ে পৌঁছাব। তাই আসুন নিজের ভাষাকে নিজের সম্পদ মনে করে এর সঠিক উচ্চারণ, সঠিক ব্যবহার করার নিমিত্তে নিজস্ব জায়গা থেকে সচেতন ও সচেষ্ট হই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"