মোহাম্মদ আবু নোমান

  ০৮ এপ্রিল, ২০১৮

বিশ্লেষণ

ফিলিস্তিনিরাই ভূমিপুত্র

অন্যের ভূমি দখল করার পরও কি সেখানে শান্তিপূর্ণ বসবাস বলা যায়! আজ যদি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দেশের কোনো অংশ কেউ দখল করে রাখে। বোমা নিক্ষেপ, অচেতন করা গ্যাস, স্টান গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও ভারী গোলাবারুদসমেত ভয়াবহ ট্যাংক ও মারণাস্ত্রের আঘাত করতে থাকে, তখনই কেবল সৌদি যুবরাজ বুঝবেন নিজ ক্ষমতা, স্বার্থ ও গদি বাঁচাতে ইসরায়েল নিয়ে তার বক্তব্য কতটা নির্দয়, মির্মম ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। তিন সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে মার্কিন সংবাদ সাময়িকী দি আটলান্টিকে সৌদি যুবরাজ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইসরায়েলের নিজেদের ভূমিতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের অধিকার আছে’। স্পষ্টতই সৌদি যুবরাজ আগুন নিয়ে খেলছেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের এই সংঘাতের দাবানলের স্ফুলিঙ্গ লেবানন, সিরিয়া, ইরানই নয়, সৌদি আরবকে জড়িয়ে আরো ব্যাপক আকার নিতে যাচ্ছে কি? ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য সৌদি যুবরাজ যদি ইসরায়েলের পক্ষ না নেন, তাহলেই বরং অবাক হওয়ার বিষয়। কারণ ক্ষমতার জন্য মাথার ওপর বড় দাদার (আমেরিকার) সমর্থন দরকার। তাই ওই দাদার আরেক ভাবশিষ্য ইসরায়েলকে হাতে রাখা চাই-ই।

আরব দেশগুলোর কারণেই সন্ত্রাসী ইসরায়েল এত সাহস পেয়ে থাকে। ফিলিস্তিনিদের ঘুম ভাঙে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে। ফিলিস্তিনিদের জমি দখল ও হত্যা দুটিই ইসরায়েলিদের কাছে ডালভাত। এ বিষয়ে বিশ্ব বিবেকও ভয়ংকরভাবে নিশ্চুপ। বিশ্ব মুসলিমদের অন্যতম পবিত্রতম মসজিদ আল-আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাস যে শহরে অবস্থিত, সেই জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের আগুনে নতুন ঘি ঢালার সঙ্গে সহিসংতা উসকে আগুনের বৃত্তে ছুড়ে ইসরায়েলকে আবারও খুশি করেছেন। অন্যদের ভূখ- দখল করে রাষ্ট্র ও বৈধ রাজধানী হতে পারে কি? একটু দেরিতে হলেও প্রমাণ হবেÑট্রাম্পের জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনে সবচেয়ে বেশি পুড়বে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশেষ করে সৌদি আরবের রাজপরিবারই। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির মতো একতরফা, একগুঁয়েমি, অযৌক্তিক, অন্যায়, অগ্রহণযোগ্য ও অপরিণামদর্শী দুঃখজনক সিদ্ধান্তের ফলাফল সৌদি রাজপরিবারকেই বেশি ভোগ করতে হবে। সৌদি আরব মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, কষ্ট, আবেগ, অনুভূতি, স্বার্থকে কখনোই প্রাধান্য দেয়নি। এতে সৌদি আরব স্বধর্মীয়সহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আস্থা ও অবস্থান হারাবে। এমনকি সৌদি আরব যদি কয়েকটি রাষ্ট্রে বিভক্তও হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তারা সর্বদা রাজ পরিবারে স্ববলয়ের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত থাকলেও নিকট অতীত ঘটনায় রাজ পরিবারে ভাঙনের সাইরেন স্পষ্ট।

ইরানের নেতারা বলে আসছেন, ইসরায়েল ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর ওপর হামলা চালানোর পর ইরান যতটা চুপ ছিল, এবার আর তা থাকবে না; এবার তারা হিজবুল্লাহকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দেবে। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়াখ্যাত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের স্থায়ীভাবে উপস্থিতি ধরে রাখার চেষ্টাকে তিনি ইসরায়েলের বেঁধে দেওয়া সীমারেখার লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন। সম্প্রতি একটি ইরানি ড্রোনকে গুলি করে ভূপাতিত করে এবং সিরিয়ায় ইরানের ব্যবহার্য একটি ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়ে ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী অবস্থানের জানান দিয়েছে।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের আগে কোনো সৌদি কর্মকর্তা ইসরায়েলের ভূমি অধিকারের বিষয়টি এর আগে মেনে নেননি। ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের সময় আরব ভূখ- দখল করে নেয়। ওই ভূমি ফেরত দেওয়ার ওপর ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক নির্ভর করবেÑএমন নীতিই রিয়াদ এত দিন লালন রেখে এসেছে। সৌদি আরব ও ইসরায়েলের কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দ্রুতগতিতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছে। কারণ দুটি দেশই এক মার্জিনে গিয়ে এ বিশ্বাসে বিশ্বাসী যে ইরান তাদের উভয়ের জন্য হুমকি। দুদেশই পরমাণু শক্তিধর ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখছে। আর দুদেশের অন্যতম মিত্র যুক্তরাষ্ট্র।

যদিও সৌদি যুবরাজের ওই বক্তব্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা সৌদি আরব ইতোমধ্যে আমেরিকার হাতের পুতুল হয়ে রয়েছে। অতএব তাকে আমেরিকার ভাষায়ই কথা বলতে হবে! এ কারণেই মুসলমানদের পবিত্র স্থান ও প্রথম কিবলার মতো ঐতিহ্যবাহী স্থান অনেকটা আমেরিকা এবং ইসরায়েলের হাতের মুঠোয় প্রায়। বর্তমানে যেসব আরব ফিলিস্তিন ভূখ-ে বসবাস করছেন, তারাই এ অঞ্চলের, এ ভূখ-ের ভূমিপুত্র। এরাই অতীতে ইহুদি, খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী ছিল এবং সময়ের পরিক্রমায় এই আরবরা বেশির ভাগ এখন মুসলিম। কিন্তু যারা বর্তমানে ইসরায়েলে বসবাস করছে, তারা ৯০ ভাগ ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এখানে এসেছে; যদিও এ আগমনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯১৯ সালের দিকে ব্রিটিশ মন্ত্রী বেফোর্সের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। তার মানে এখন যারা ইসরায়েলে বসবাস করছে, তারা বহিরাগত। সুতরাং ফিলিস্তিনি মুসলিমরাই এ ভূমির ভূমি সন্তান। আর ইসরায়েলিরা মূলত ইউরোপ থেকে নির্বাসিত একটি জাতি যাদের পিতৃপুরুষ কখনোই এখানের বাসিন্দা ছিল না।

১৯৭৬ সালের ৩০ মার্চ ভূমি থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৬ নিরস্ত্র প্রতিবাদী ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। সেই নিহতদের স্মরণে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিরা গত ৩০ মার্চ ঘিরে আয়োজন করেছিল নিজ পিতৃভিটার হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার মিছিল। নিরস্ত্র প্রতিবাদী মিছিলে গুলিবর্ষণ করে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে ৩০ জন নিহত ও প্রায় ২ হাজার আহত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সন্ত্রাসী কায়দায় বলেছেন, ‘তার সৈন্যরা জানে, বুলেট-গুলি কোথায় বেঁধাতে হবে, তারা নাকি যা করেছে, ঠিকই করেছে।’ প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল কর্তৃক পরিচালিত এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে কারো কোনো হেলদোল নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, গণগত্যা, মানবাধিকার, যুদ্ধাপরাধ, মানবিক বিপর্যয়Ñসবকিছুই যেন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের বেলায় অকার্যকর।

ফিলিস্তিনে মানবতার বিপর্যয় ও গণহত্যা আধুনিক সভ্যতার দীর্ঘস্থায়ী সংকট। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ইসরায়েলের দাবনীয় শক্তির কাছে সবাই যেন নতি স্বীকার করছে। ফিলিস্তিনিদের এই দুর্গতির জন্য প্রথমত, আরবদের মধ্যকার অনৈক্য ও গণতন্ত্রহীনতাই দায়ী। এই অগণতান্ত্রিক শাসকদের আবার টিকিয়ে রেখেছে পশ্চিমা শাসকরা। পশ্চিমারাই নিজ স্বার্থে চায় না আরবে গণতন্ত্র আসুক। গণতান্ত্রিক আরবকে পশ্চিমাদের বড় ভয়। কারণ, আরবে যদি জনসাধারণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তা ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের স্বার্থের ক্ষতি হতে পারে। নানা অক্ষে বিভাজিত আরব এখন বেশির ভাগই অগণতান্ত্রিক শাসকদের নিয়ন্ত্রণে। আরবদের মধ্যে বিরোধ এতটাই প্রবল যে প্রয়োজনে এরা ইসরায়েলেরে পক্ষ নিতেও লজ্জা পাচ্ছে না। সৌদি আরবই এর বড় উদাহরণ।

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আরব রাষ্ট্রগুলোর বিভাজন দূর না হওয়ার পর্যন্ত ফিলিস্তিন ইস্যুতে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আসা সম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উচিত নিজেদের মধ্যকার বিবাদ মিটিয়ে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানো।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist