দিলীপ কুমার আগরওয়ালা
ফুটবল
কিশোরীদের হংকং জয়
ছেলেদের ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান যখন তলানিতে, তখন নিজেদের সামর্থ্য দেখিয়ে দিয়েছে অনূর্ধ্ব-১৫ প্রমীলা ফুটবলাররা। হংকংয়ে অনুষ্ঠিত জকি ক্লাব গার্লস ইয়ুথ ফুটবল টুর্নামেন্টে তারা স্বাগতিকদের ৬-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। চার জাতির এ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের কিশোরীরা মালয়েশিয়াকে ১০-১ গোলে হারিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার পরিচয় দেয়। পুরুষদের ফুটবলে এশিয়ার অন্যতম সেরা দল ইরানের মেয়েদের তারা হারায় ৮-১ গোলের ব্যবধানে। টুর্নামেন্টে কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যরা প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে ২৪ গোল করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। তার বিপরীতে নিজেরা গোল হজম করেছে মাত্র দুটি।
ছোট্ট দেশ হংকংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের ফুটবল খেলার সূচনা হয়েছিল ৪৩ বছর আগে। তাদের কাছে ৯-১ গোলে পরাজয়ের রেকর্ডও আছে বাংলাদেশের। জকি ক্লাব গার্লস ইয়ুথ ফুটবল টুর্নামেন্টে হংকংকে ৬-০ গোলে হারিয়ে সে লজ্জা কিছুটা হলেও কমিয়ে আনল বাংলাদেশের মেয়েরা। গাঁও-গ্রামের মেয়েরা দেখিয়ে দিল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মনোভাব থাকলে জয়ী হওয়া কোনো ঘটনাই নয়। জকি ক্লাব টুর্নামেন্টের ফাইনালের চতুর্থ মিনিটেই তহুরা দলকে এগিয়ে দেয়। এরপর ৩৯ মিনিটে গোল করে সাজেদা। ৪০ মিনিটে আরো একটি গোল করে দলকে প্রথমার্ধেই ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে দেয় তহুরা। জয়ের বিষয়টা পাকাপাকি হওয়ার পর যেন আরো দুরন্ত হয়ে ওঠে ছোটনের শিষ্যরা। দ্বিতীয়ার্ধে গোলের ক্ষুধা মেটাতে ৬৭ মিনিটে গোল করে শামসুন্নাহার জুনিয়র। ৭২ মিনিটে দলের পক্ষে গোল করে অনু চিং। তহুরা ৭৩ মিনিটে হ্যাটট্রিক পূরণ করে। এ টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতাও সে। তিন খেলায় ৮ গোল দিয়ে সে সবাইকে চমকে দিয়েছে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে কয়েক মাস আগেই ঘরের মাঠে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় মারিয়া মান্ডার নেতৃত্বাধীন এ দলটি। এবার বিদেশের মাটিতেও বিজয় পতাকা ওড়ানোর কৃতিত্ব দেখাল তারা।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মারিয়া বলেছে, ‘আমরা এই ট্রফিটা দেশের জন্য জিতেছি।’ অনূর্ধ্ব-১৫ প্রমীলা ফুটবল দলের কোচ তার শিষ্যদের এই অসামান্য বিজয়কে মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশের নারী ফুটবল দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাদের অনন্য সাফল্যের জন্য। ফুটবল দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। মেয়েদের এ জয় ফুটবলের পুনর্জাগরণে অবদান রাখলে তা হবে এক বড় অর্জন।
ক্রিকেট সাফল্যের বিপরীত চিত্রে বসবাস করছে দেশের ফুটবল, যা কল্পনা করা যায় না। অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে ক্রীড়াটির উন্নয়ন চোখে পড়ার কথা ছিল। অবশ্য সেটা একের পর এক সাফল্য পাওয়ার মধ্য দিয়ে, যা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১০ সালে সাউথ এশিয়ান গেমস ফুটবলের লড়াইয়ে স্বর্ণপদক জয় করেছিল বাংলাদেশ জাতীয় দল (অনূর্ধ্ব-২৩)। এমন সাফল্য আগেও ধরা দিয়েছে। তাতে ধারাবাহিকতা দেখা যায়নি।
ফুটবলের বেলায় সে দৃশ্যই ফুটে উঠেছে স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত। তা নতুন করে কলমের কালিতে তুলে না ধরলেও হয়। ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট কাপ, ১৯৯৫-তে মিয়ানমারের চ্যালেঞ্জ কাপ, ১৯৯৯ সাফ গেমস, ২০০৩-এ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেও এই ক্রীড়া উন্নয়নের মুখ দেখেনি! ঘুরেফিরে গভীর সমুদ্রে তলিয়ে গেছে।
যদি আমরা ফুটবলের ইতিহাসের দিকে তাকাই। তাহলে বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালি অতীত দেখব। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েই ১৯৭৪ সালে ফিফার সদস্যপদ লাভ করে এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে শুভসূচনা করে। বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়। কিন্তু পরে তা ধরে রাখতে পারেনি।
১৯৭৩ সালের ২৬ জুলাই, প্রথম অফিসিয়াল খেলায় থাইল্যান্ডের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। খেলাটি ২-২ সমতায় শেষ হয়। ২৬ জুলাই থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত এশিয়ার বিভিন্ন দলের বিপক্ষে ১৩টি প্রীতি খেলায় অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ, যার তিনটিতে ড্র এবং দশটিতে পরাজিত হয়। এক বছর পর আরো দুটি প্রীতি খেলায় অংশগ্রহণ করে এবং দুটিতেই পরাজিত হয়। ১৯৭৮ সালে ভারত এবং মালয়েশিয়ার বিপক্ষে দুটি প্রীতি খেলায় পরাজিত হয় বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে তারা ১৯৮০ এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ করে। প্রথম দুই খেলায় কাতার এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে ড্র করে বাংলাদেশ। তবে কাতারের বিপক্ষে দ্বিতীয় খেলায় ৪-০ ব্যবধানে পরাজিত হয়। অবশ্য আফগানিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় খেলায় ৪-১ ব্যবধানে জয় লাভ করে এশিয়ান কাপে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। এটিই ছিল বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসের প্রথম জয়।
এবার বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের হোস্ট হয়েছিল। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে এশিয়ার ছয়টি দল অংশগ্রহণ করে এবং এ প্রতিযোগিতা ফিফার অফিশিয়াল স্বীকৃতি পায়। এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ ফাইনালে উঠে এবং প্রতিপক্ষ মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়া ৩-২ গোলে জয়ী হয়।
অপ্রিয় সত্য কথা হচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের ফুটবলের অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয়। এখন বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা ক্রিকেটার হতে চায় বেশি। ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে খুব আগ্রহী নয় তারা। তার মূলে রয়েছে অনিশ্চয়তা। মানুষ যে ফুটবল নিয়ে অনাগ্রহী তা নয়। ফুটবল ক্যারিয়ার নিয়ে অনাগ্রহী। সবাই শৌখিন ফুটবলার। এই শৌখিন ফুটবলার থেকে কতটুকু মানসম্মত খেলোয়াড় পাওয়া যাবে তা বলাই বাহূল্য। আট বছর বয়সে মেসি বার্সালোনার হয়ে খেলেছে অথচ আট বছর বয়সে আমাদের ছেলেমেয়েদের মাঠে যেতে দেই না, পা ভেঙে যাবে বলে। তারচেয়ে বড় কথা ফুটবলে আমাদের অনুপ্রেরণা নেই। ফুটবলের খেলাগুলো হয় ঢাকা না হয় চট্টগ্রামে। ইদানীং সিলেট যুক্ত হয়েছে সেই তালিকায়। কিন্তু সারা দেশের মাঠে খেলা হওয়ায় সাধারণ মানুষ মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে পারে না। ফুটবলকে আমরা এখনো সর্বজনীন করতে পারিনি।
আমরা মনে করি, বাংলাদেশের ফুটবল খেলাকে আরো প্রসারিত করা উচিত। আন্তস্কুল, আন্তকলেজের পাশাপাশি উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ফুটবল খেলাকে এগিয়ে নেওয়া দরকার। প্রতিটি উপজেলায় ফুটবলের জন্য আলাদা স্টেডিয়াম করা উচিত। প্রতিটি খেলা হওয়া উচিত লীগ পদ্ধতিতে। প্রতিটি উপজেলা ও জেলায় ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকা উচিত। সারা দেশের মাঠে যখন মামুনুল, এমিলি, জাহিদ, মিশুরা খেলবে তখন তাদের দেখে এ দেশের হাজারো শিশু মনের ভেতর ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। মা-বাবারা তাদের সন্তানকে খেলতে অনুপ্রাণিত করবে।
লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই
"