হিমেল আহমেদ

  ০৬ এপ্রিল, ২০১৮

নিবন্ধ

বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি

মাত্র কয়েক দিন পরই বাংলা নববর্ষ। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার আলাদা একটি সুনাম আছে তার সাংস্কৃতিক চর্চা আর জৌলুশের কারণে। ধারণা করা যায় বাংলা সংস্কৃতি চার হাজার বছর পুরোনো! নববর্ষ বাঙালির একটি সর্বজনীন উৎসব। যুগ যুগ ধরে দুই বাংলার বাঙালি এ উৎসবকে অত্যন্ত মর্যাদা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পালন করে আসছে। বাঙালির এ নববর্ষ পালনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারো মাস বহুকাল আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে। সেই সূত্র ধরে বর্তমানে ১৪ বা ১৫ এপ্রিল নববর্ষ পালন হয়ে আসছে। প্রাচীনকালে হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন ভারত উপমহাদেশের আসাম, বঙ্গ, কেরল, মণিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাট আকবরের ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর বাংলা পত্রিকা পালনের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। আদিকাল থেকেই বাংলার প্রধান পেশা কৃষিকাজ। সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষদিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে আদেশ দেওয়া হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। যে উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবেরও আয়োজন করা হতো। তখন থেকেই এ উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে আমরা নববর্ষ পালন করছি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাংলার সংস্কৃতি ক্ষয় হতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা ছিল সংস্কৃতির ধারক। এখনো বাংলা দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে এবং বাংলা সংস্কৃতির উৎসবগুলো পৃথিবীব্যাপী উদযাপিত হয়। বর্তমান সময়ে এসে আমরা দেখতে পাই ক্রমাগত বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটছে। যুগে যুগে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরা বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করে আসছেন। বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বাংলার সঙ্গে। আমাদের বাংলা ভাষা সুলতানি আমলে কোর্টের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৬ এবং ১৭ শতাব্দীতে এটি আরো সমৃদ্ধ হয়। আরাকান রাজ্যেও এ ভাষার প্রচলন ছিল। ১৯ এবং ২০ শতাব্দীর শেষে কলকাতায় এটির আধুনিকায়ন হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রথম লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পরস্কার লাভ করেন, যা বাংলাকে নতুন রূপ ও প্রধান্য প্রধান করে। কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠেন ব্রিটিশদের বিরোধী লেখক। বাংলায় বিদ্রোহ করে হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী কবি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমুখ লেখকরা বাংলার গদ্য সাহিত্যকে উন্নত করেছেন। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন। বঙ্কিকচন্দ্র চট্টোপ্রাধ্যায় বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক। সুকান্ত ভট্টাচার্য, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, পল্লী কবি জসীমউদদীন, জীবনানন্দ দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধায়ের মতো সাহিত্যিকরা বাংলা সাহিত্যকে উন্নতির শিখরে পৌঁচ্ছে দিয়েছেন। যাদের জন্য বাংলাকে বিশ্ব জেনেছে, পড়েছে। বর্তমানে এই বাংলা সাহিত্যগতভাবেও দুর্বল হয়ে আসছে। আজ পর্যন্ত দ্বিতীয় কোনো রবীন্দ্রনাথ বাংলার জমিনে জন্মায়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তমানে বাংলা ভাষার বিকৃতি ও অপব্যবহার বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কলুষিত করছে। সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাংলাদেশ ও ভারত এই দুদেশই বাংলার সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে আছে। তবে বর্তমানে আধুনিকতার বেড়াজালে আমরা অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছি। বাংলার জারি, সারি, ভাটিয়ালি গান আর নেই। নববর্ষ পালনের প্রধান মাধ্যম ‘হালখাতা’ ছিল। কিন্তু বর্তমানে হালখাতার প্রচলন অনেকাংশ কমে গেছে। প্রতি বছর নববর্ষে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়, তবে এ মেলাতে আগের মতো জৌলুশ দেখা যায় না। পান্তা ইলিশ খাওয়ার ঐতিহ্যটাও ক্রমেই কমে এসেছে বাংলাদেশে ইলিশ মাছের অস্বাভাবিক দামের কারণে। দেশের একাংশ বিত্তবানরাই শুধু ইলিশ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য রাখেন এমন বলাটাও ভুল হবে না। বিলুপ্ত হয়েছে তালপাতার বাঁশি! বৈশাখের বৈশাখী মেলা আর আগের মতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠে না। কমে গেছে রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতির কদর। বাংলার বিখ্যাত মসলিন আজ জাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে। অথচ এই মসলিন কাপড় একসময় বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ছিল। ঢাকায় একসময় শোলার কারিগর ছিল। ছিল মাদুরশিল্প ও মসলিন। সেই ১৮৫১ সালে লন্ডনে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পাঠানো হতো মসলিন কাপড়। মুঘল ও মুর্শিদাবাদের দরবারেও পাঠানো হতো মসলিন কাপড়। বিখ্যাত ছিল বাংলার রেশম কাপড়, যা আজ নেই বললে চলে। হস্তশিল্প, কারুশিল্প বিলুপ্ত হয়েছে। আজ আধুনিকতার শেকলে আবদ্ধ হয়ে গেছি আমরা। তাই ভুলতে বসেছি বাংলার চর্চা। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সব উৎসব পালনে আগ্রহী এই বাঙালি। বাংলাদেশ ছাড়াও এই ঐতিহ্য পালন করে থাকে কলকাতা। তবে দেখা যায় বাংলা নববর্ষ পালনের আনন্দ ইংরেজি নববর্ষের আনন্দের কাছে ফিকে পড়ে যায়। তবু বাঙালি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলার এই ঐতিহ্যকে যথাযথ মর্যাদায় পালনের। একদিনের জন্য হলেও আধুনিক বাঙালি সাজছে চিরচেনা গ্রামীণ সাজে। পালন করছে নববর্ষ পান্তা খেয়ে সেটা হোক গরম ভাতে পানি ঢেলে। ইলিশ না পেলেও সিলভার, রুই, কাতলা দিয়েও পান্তা-ইলিশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছি এটাও কম নয়! আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি হওয়ায় মানুষ ক্রমেয় ইংরেজি কালচারের দিকেই ঝুঁকছে বেশি বিপরীতে ভুলতে বসেছে স্বকীয় সত্তা! আসুন আমরা আধুনিক হই, তবে নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে নই। বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist