মোহাম্মদ আবু নোমান

  ০৫ এপ্রিল, ২০১৮

মতামত

ব্যাংক : নতুন সিদ্ধান্ত পুরনো ভাবনা

তারল্য বাড়ানোর জন্য বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ছুটছে গ্রাহকদের দুয়ারে দুয়ারে। আগে অলস ও না ঘুমিয়ে যারা ঋণ নিয়েছিল, তাদের দরজায় নিয়মিত যাতায়াত থাকলে আমানত ঘাটতিতে বেসরকারি ব্যাংককে এমন হা-হুতাশ করতে হতো না। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই একসময় ব্যাপক অলস টাকা পড়ে থাকত। এখন সরকারি ব্যাংকে কিছু অলস তারল্য থাকলেও বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় অলস তারল্য থাকা তো দূরের কথা, নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থও নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোয় ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা অলস তারল্য ছিল। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তা কমে মাত্র ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এই মাত্র ৮৬ হাজার কোটি টাকার প্রতি নজর পড়েছে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির।

সরকার বেসরকারি ব্যাংক রক্ষার নামে এখন সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে জমা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদ্যমান নিয়মে সরকারি তহবিলের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যায়। বর্তমানে তো বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি আমানতের এই ২৫ শতাংশ খেয়ে ফেলেছে। এবার তাহলে শুরু হবে ঘোষিত ৫০ শতাংশ আমানত খাওয়া। সরকারের এ ঘোষণাকে সহজভাবে নেওয়া যাচ্ছে না বলে বেশির ভাগ বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সংকটের উৎসে হাত না দিয়ে, সীমাহীন দুর্নীতি, ঋণ অনিয়ম ও ব্যাংক লুটেরাদের কোনো বিচার না করে, উল্টো এখন দেওয়া হবে আরো ৫০ শতাংশ আমানত! এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় আবার তারল্য সংকট শুরু হওয়ার সম্ভানা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। তারল্য সংকটের মূল কারণ ছিল বেপরোয়া ঋণ। এর বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বিনিয়োগের পরিবেশ ফেরাতে এবং বেসরকারি ব্যাংক রক্ষায় এ বিধানটির সংশোধন জরুরি এ কথা ঠিক। কিন্তু মনে রাখতে হবেÑবর্তমানে যেভাবে বেসরকারি ব্যাংক খালি হয়েছে, এখন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পরিচালকদের ব্যাংকে সরকারি আমানতের বড় অংশ আবারও চলে যাবে না এর গ্যারান্টি কোথায়? এর ফলে পুরো ব্যাংক খাতে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ জন্য আগে জরুরি, প্রভাব খাটিয়ে কোনো বেসরকারি ব্যাংক যাতে অধিক পরিমাণ সরকারি আমানত নিতে না পারে, সে জন্য একটি নিয়ম কাঠামো তৈরি করা। বেসরকারি খাতের ব্যাংকবিশেষ যেন এ সুবিধা অনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে না পারে, সে ব্যাপারে শুরু থেকেই সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংককে সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে।

এর আগে বেসরকারি ব্যাংকের আবদার পূরণ করতে গিয়ে এক পরিবার থেকে দুজনের পরিবর্তে চারজনের পরিচালক হওয়ার সুযোগ রেখে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী পাস করার সুবাদে ব্যাংকগুলোয় জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে মূলত পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ও পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে, যা ছিল স্পষ্টতই একটি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত। এতে ব্যাংকগুলো ৫০-৬০টি পরিবারের হাতে কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে। এসব নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু এতে খুশি হতে পারেননি ব্যাংক উদ্যোক্তারা। তাই তারা চাচ্ছেন ব্যাংক নিয়ে সংবাদ প্রকাশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ। ব্যাংক নিয়ে যাতে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করা না হয়, সে জন্য ফিন্যান্সিয়াল ইনফরমেশন অ্যাক্ট প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন ব্যাংক উদ্যোক্তারা। অবশ্য অর্থমন্ত্রী আইন প্রণয়নের বিষয়টি নিয়ে বাজেটের সময় আলোচনা হবে বলে বিএবিকে আশ্বস্ত করেছেন।

কিন্তু কথা হলোÑআর্থিক খাত নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞার জন্য আইন পাসের যে আবদার করা হয়েছে, সেটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য? বিএবি ফারমার্স ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের ব্যর্থতার দায়ভার নিজেদের ঘাড়ে না নিয়ে সংবাদ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আইন চাচ্ছে! কোনো সংবাদ মিথ্যা, ভিত্তিহীন বা অগ্রহণযোগ্য হলে তারা প্রতিবাদ করতে পারেন, আইনগত ব্যবস্থায় যেতে পারেন। এসব [মামুবাড়ির আহ্লাদি] আবদার সরকার মেনে নিতে পারে কি? সরকারকে বুঝতে হবে সব আবদার পূরণ করা যায় না। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের লবিস্ট সংগঠন হিসেবে বিএবি নানা ধরনের সুবিধা চাইতেই পারে। কিন্তু তারা কোনো কিছু চাইলেই দিতে হবেÑএমন মানসিকতা দেশের জন্য মঙ্গল ও জনবান্ধব হবে কি নাÑদেওয়ার আগে তা কয়েকবার ভেবে নেওয়া দরকার।

গত এক বছরে খেলাপি ঋণ ১২ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ৪৪ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এ ছাড়াও ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করেছে ব্যাংকগুলো। ঋণ অবলোপন করার জন্য ৪৫ হাজার কোটি টাকা প্রভিশন করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর আটকে গেছে ২ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। এসব কারণেই তারল্য সংকট প্রকট হয়েছে।

ব্যাংকগুলোর দুর্নীতি ও ঋণ কেলেঙ্কারির হোতাদের বিচারের আওতায় না এনে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট তথা অন্যান্য সমাধানে এই সাময়িক পদক্ষে যেন জাতীয় সম্পদের অপব্যয়েরই নামান্তর না হয়। এসব সাময়িক কোনো ব্যবস্থা ব্যাংক খাতকে সুষ্ঠু কাঠামোর ওপর দাঁড় করতে পারবে কি নাÑবারবার তা ভাবতে হবে?

লেখক : বিশ্লেষক ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist