শাহ বুলবুল
শিক্ষা
বাবুছড়া গ্রামে এক আলোর নদী
‘উড়ে গেছে; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর/ কে যেন, আজো আমি জানি নাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর।’ জীবনানন্দ দাশের পথ হাঁটা মানুষটিকে আমরা জেনেছি। অনুভব করেছি মিনারের মাথায় রাখা শান্তির মনুমেন্ট। তার ইচ্ছে তলে বাদামি জীর্ণ পাতা সবুজ হয়ে আবারও চলতে শিখেছে। যিনি কারুশিল্পীর মতো আলোর নদী জোয়ারের ধারায় নিয়ে গেছেন মানুষের প্রাণে প্রাণে। তিনি অনাবাদী মানুষের মনে আলোর আবাদ করা পাহাড়ের মতোই বিনয়ী। কল্যাণিয়া প্রতীক অধ্যক্ষ ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো।
অনেকটা পিছিয়ে পড়া আদিবাসীদের ঘরে আলোর বার্তা ফেরি করা একজন নিভৃতচারী মানুষ অধ্যক্ষ ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো। শৈশবের রূঢ় বাস্তবতায় হেরে না গিয়ে কৈশোরকে গড়েছেন স্বপ্নচারী এক নিরেট বাস্তবতার নিরিখে। জীবনের রণক্ষেত্রে বিজয়ী ভেন নিজেকে গড়েছেন যোগ্য থেকে যোগ্যতর হিসেবে। তিনি ভিক্ষু তবে মানুষের মননশীলতাকে মেখে নিয়েছেন সর্বাঙ্গে। সেই চিরসত্য কথার মতোইÑসবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই।
আদিবাসীদের মধ্যে মুক্তির গান গেয়ে জ্ঞানের আলো বিলানো মানুষ অধ্যক্ষ ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর জন্ম ১৯৫২ সালে খাগড়াছড়ির দিঘীনালা উপজেলার বাবুছড়া গ্রামে। তার গৃহী নাম বলেন্দ্র দেব চাকমা। বাবা প্রয়াত নরেন্দ্র লাল চাকমা এবং মা প্রয়াত ইন্দ্রপতি চাকমা। মহাথেরো ১৯৬৮ সালে দিঘীনালা হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৭২ সালে হাটহাজারী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে বিএ অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি এবং ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
অধ্যক্ষ ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো ১৯৬৮ সালে মাধ্যমিক পাসের পরপরই ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করে মানবসেবায় মনোনিবেশ করেন। তরুণ বয়স থেকেই একজন সাধারণ ভিক্ষু হয়েও ভেন মনেপ্রাণে অনুভব করেছেন পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য উন্নয়নের একমাত্র পথ হচ্ছে শিক্ষা। সেই থেকে ভেন শুরু করেন এক অবিশ্রান্ত লড়াই। এ লড়াইয়ের মাঠপ্রান্তরে ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো নানা বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হলেও হেরে যাননি। মানুষের কল্যাণ আর নিজের আত্মবিশ্বাসকে হাতিয়ার করে চালিয়ে আসছেন শিক্ষা বিস্তারের নিরন্তর এক সংগ্রাম।
১৯৭৪ সালের কথা। ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। টগবগে এক যুবকের চোখেমুখে জীবন জয়ের অনাবিল আশা। এ সময় তার দীক্ষাগুরু জ্ঞানশ্রী মহাথেরো প্রতিষ্ঠিত খাগড়াছড়ি জেলার পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। অনেকটা বাধ্য হয়ে অনাথ আশ্রমটির দায়িত্ব গ্রহণ
করলেও তিনি সেখানে একটা আদর্শিক ভিত্তির
সূচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানেই ভেন প্রতিষ্ঠা করেন ধর্মোদয় পালি কলেজ এবং অনাথ আশ্রম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়, যা আজও সুনামের সঙ্গে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো পাহাড়ি শিশুদের কোমল অন্তরে শিক্ষার আলো জ্বালাতে শ্রদ্ধাময়ী পাহাড়ের গায়ে গড়ে তোলেন ‘মোনঘর’ নামের অতি মানবিক এক শিশু শিক্ষা সদন। এ মোনঘরই আজ বিশ্বখ্যাত। শিশু শিক্ষায় মানুষের চিন্তার রেণু বহন করে।
মোনঘরেই ভেন থেমে থাকেননি। এই মোনঘর শিশু সদনকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়, মোনঘর পালি কলেজ, মোনঘর প্রি-ক্যাডেট স্কুল, মোনঘর ভাষা শিক্ষাকেন্দ্রসহ ১৪টি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ওই দূর পাহাড়ের সীমানা ছাড়িয়ে অধ্যক্ষ ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো শিক্ষার আলো ছিটিয়ে দিতে চান দেশের প্রতিটি প্রান্তে। এ প্রয়াস থেকে ২০০৪ সালে রাজধানী ঢাকার মিরপুরে প্রতিষ্ঠা করেন বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট কলেজ। একজন শিক্ষক, শিক্ষার মানুষ ভেন আলোকিত মানুষ গড়ার চেতনাকে অবিরাম করতে গড়ে তোলেন বনফুল আদিবাসী এডুকেশন ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট।
ব্যক্তি জীবনে একজন সৃজনশীল বৌদ্ধভিক্ষু ভেন কর্মক্ষেত্রে সর্বাধিক এবং সর্বজনীন মতের বিশ্বাসী, যা তাকে একজন সফল সংগঠকে পরিণত করেছে। অধ্যক্ষ ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি মননশীল কর্মপরিধির মাধ্যমে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘকে বিশ্ববৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নজরে আনতে সক্ষম হন। অধ্যক্ষ ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর সাংগঠনিক জীবনে এক অনন্য মাইলফলকের নাম পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ। তিনি প্রথম মেয়াদে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়কালে মানবিকতার দিক থেকে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ আদিবাসী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাঙ্গলিক আশার প্রতীকে পরিণত হয় এবং বৌদ্ধদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ বুড্ডিস্টের সদস্যপদ অর্জন করেন। এ সময় তিনি পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা গমন করেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা ও সেমিনারে অংশ নেন।
ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার এবং রাঙামাটি আনন্দ বিহারের অধ্যক্ষ ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো সারা বিশ্বে বসবাসরত বৌদ্ধদের তীর্থ সংঘ বিএলআইএর বাংলাদেশ অধ্যায়ের প্রধান হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৯৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অত্তদীপা ফাউন্ডেশন। ১৯৯৮ সালে অত্তদীপা ফাউন্ডেশন বিএলআইএর সদস্যপদ লাভ করে।
অধ্যক্ষ ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর পরিবেশ ভাবনা সুগভীর। তিনি মনে করেন, পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হলে পৃথিবীতে মানুষসহ প্রতিটি প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। পরিবেশ নিয়ে তার অনূদিত বই ‘পরিবেশ ও আধ্যাত্মিক সংরক্ষণ’।
এটি চিনের বৌদ্ধধর্মীয় মহাচার্য শিং উনের প্রদত্ত বক্তব্যের অনূদিত রূপ। বইটি অনুবাদের মাধ্যমে ভেন বাংলাদেশের পাঠকসমাজে পরিবেশ সচেতনতায় ব্যাপক চেতনাগত জাগরণ সৃষ্টির প্রয়াস রেখেছেন।
আদিবাসী সমাজ তথা সমাগ্র বাংলাদেশের শিশুশিক্ষার কল্যাণিয়া প্রতীক অধ্যক্ষ ভেন প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর জন্য আমরাও অনেক অনেক কল্যাণ কামনা করছি। তার এগিয়ে চলা লাখো কোটি ভোরের পাখির মতো আমাদের আলোর পথে ডাক দিয়ে যাবেÑএমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক : কলামিস্ট
"