নিতাই চন্দ্র রায়

  ২৯ মার্চ, ২০১৮

পাট

প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তি

বাংলাদেশের কৃষক যখন পাটের ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কিত, তখন বিশ্ববাজারে প্রতিটন পাটের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ ডলার। কারণ হিসেবে বলা হয়, বিশ্বের বৃহৎ পাঁচটি মোটর গাড়ি উৎপাদক কোম্পানি তাদের বিলাসবহুল গাড়ির অভ্যন্তরীণ কাঠামো ও সাজসজ্জার বড় একটি অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে পাটজাত পণ্য, যা টেকসই দৃষ্টিনন্দন ও আরামদায়ক। বিশ্ব পাটের বাজার পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ন্যাচারাল ফাইবার ওয়ার্ল্ড ওয়াইড’-এর গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়েছে, ২০১৯ সালের মধ্যে সদস্যভুক্ত সব দেশ পণ্যের মোড়কসহ বহনের জন্য সব ব্যাগ প্লাস্টিক ও কৃত্রিম আঁশজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে পাটকাঠি পুড়িয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হচ্ছে চারকোল, যা প্রিন্টারের কালিসহ ফেসওয়াস, পানির ফিল্টার, বিষ ধ্বংসকারী ওষুধ ও জীবন রক্তাকারী ওষুধসহ নানা পণ্য তৈরির কাজে ব্যবহার করার জন্য বিদেশে রফতানি হচ্ছে। অন্যদিকে জার্মানি, পর্তুগাল, ফ্রান্সসহ বেশ কিছু দেশ ইতোমধ্যে প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা ও এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোও টেকসই পণ্য হিসেবে পাটের ব্যবহার বেশ বৃদ্ধি করেছে। এইচএনএম জারার মতো বড় বড় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে বহুমুখী পাটপণ্য কেনার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। এর ফলে বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানিতে দেখা যাচ্ছে ঊর্ধŸগতি, যা বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক বিষয় ও সুসংবাদ।

আশার কথা, বাংলাদেশের পাট থেকে উন্নত মানের ভিসকস সুতা তৈরি ও বাজারজাতের সম্ভাবনা যাচাই শুরু হয়েছে। এ লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফিনল্যাল্ডে আড়াই কেজি শুকনো পাট পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। সম্ভাব্য যাচাইয়ের ফল ইতিবাচক হলে প্রতি বছর প্রায় হাজার কোটি টাকা আমদানি সাশ্রয় হবে। সম্ভাবতা যাচাইয়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ সরকার। ২০ সপ্তাহের মধ্যে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের তিনটি প্রতিষ্ঠানের পাট থেকে ভিসকস সুতা তৈরির রাসায়নিক পরীক্ষা, গুণগতমান নির্ধারণ, বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া, কারখানায় উৎপাদনের জন্য নকশা তৈরির সম্ভাবনা যাচাইয়ের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। জানা যায়, বিশ্বব্যাপী কাঠ থেকে ভিসকস সুতা তৈরি করা হয়। এ সুতা দিয়ে তৈরি পোশাক অনেক আরামদায়ক দামও সুতি কাপড়ের চেয়ে ক্ষেত্রবিশেষে দেড় গুণ বেশি। আখ থেকেও ভিসকস তৈরি হয় স্বল্প আকারে। তবে পাট থেকে বাণিজ্যিকভাবে ভিসকস তৈরি করতে পারলে তা হবে এ দেশের জন্য এক বিরাট অর্জন। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এককভাবে সাফল্যের দাবি করতে পারবে। বাংলাদেশের বস্ত্র উৎপাদন কারখানাগুলো বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন ভিসকস আমদানি করে, যার মূল্য ৭০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা। এই ভিসকস দেশে উৎপাদন হলে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশ থেকে আর আমদানি করার প্রয়োজন হবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৬৩৭ কোটি ৮২ লাখ টাকার বেশি মূল্যের ৩৩ হাজার ৭৩৭ টন ভিসকস আমদানি করা হয়।

বাংলাদেশের চার কোটি মানুষ সরাসরি পাট খাতের সঙ্গে জড়িত। সরকার জুট প্যাকেজিং আ্যাক্টের মাধ্যমে ১৭টি পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় দেশে পাটের ব্যবহার ও উৎপাদন বেড়েছে। পাটচাষিরাও আগের চেয়ে ভালো দাম পাচ্ছেন। ২০১৪ সালে দেশে ৬৫ লাখ বেল, ২০১৫ সালে ৭০ লাখ বেল, ২০১৬ সালে ৮৫ লাখ বেল এবং ২০১৭ সালে ৯২ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়। দেশের উদ্যোক্তারা পাটপণ্যের বহুমুখীকরণে অত্যন্ত মনোযোগী ও আন্তরিক। এ খাতে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে সরকার এরই মধ্যে ৬টি টেক্সটাইল কলেজ ও ১২টি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। পাটপণ্য বহুমুখীকরণের জন্য পাটবিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম আরো জোরদার করা প্রয়োজন। স্বল্পমূল্যে পাটের ব্যাগ উৎপাদনে ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। এতে দেশের মানুষকে পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহারে আরো উৎসাহিত করা যাবে। এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের বক্তব্য হলোÑএখন সময় এসেছে নতুন চালিকাশক্তি খুঁজে বের করার। এ ক্ষেত্রে পাটের সম্ভাবনা খুুব বেশি। মধ্য-আয়ের দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য আমাদের অর্থনীতির জন্য নতুন একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি প্রয়োজন, যা পাটের মাধ্যমে সম্ভব। পাটপণ্য বহুমুখীকরণের জন্য দেশের উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে নিজেদের তৈরি করছেন। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বেশ আশাব্যঞ্জক। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পাট হবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তি। এ শিল্প থেকে দেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে দেওয়া সম্ভব।

পাটের বহুবিধ প্রচলিত পণ্য ছাড়াও অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে জার্মানিতে রফতানি হচ্ছে পাট পাতা থেকে তৈরি চা। বাংলাদেশে কিছুদিন আগে এ চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাটপাতা থেকে চা উদ্ভাবন করেছেন। পাট থেকে চা তৈরির জন্য ফুল আসার আগে গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করতে হয়। পরে তা সূর্যের আলোয় শুকিয়ে গুঁড়া করতে হয়। এরপর মধু বা চিনি দিয়ে এ চা পান করতে হয়। পাটপাতার চা রফতারি পরিমাণ কম হলেও তা বাড়ানোর জন্য কারখানা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি কারখানা নির্মাণ করা হবে। এখন থেকে দেশে চা-শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হলো পাটের পাতা থেকে তৈরি নতুন চা। এতে দেশের দুটো খাত অর্থাৎ পাট ও চা উভয় শিল্পসমৃদ্ধ হবে এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বহু লোকের।

পাট রফতানিকারকদের সংগঠন জুট এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকার পাটপণ্য বিদেশে রফতানি হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশের বাইরেও কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, সুদান, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ১২০টি দেশে এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে ৫০০ বিলিয়ন পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। তাই পাটজাত শপিং ব্যাগের রফতানি ক্ষেত্রে এ দেশের ভালো সুযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মিলে ৭০০-এর বেশি প্রতিষ্ঠান পাটজাত পণ্য তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বিগত দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে সারা বিশ্বে তিন গুণ বেড়েছে। এর তুলনায় পাটজাত পণ্য উৎপাদন খুবই কম। তবু এ পণ্যগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখছে। দুনিয়াব্যাপী পাটের ব্যাগের চাহিদা বৃদ্ধি ও আমাদের দেশের উন্নত মানের পাট এ দুটো হাতিয়ার কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশেরও সফলতা আসতে পারে। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এর আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়লেই দেশের পাটকলগুলো সারা বছর কর্মচঞ্চল থাকতে পারে। পাটের বাজার মূল্য বাড়তে পারে এবং চাষিরাও পেতে পারেন সোনালি আঁশের ন্যায্যমূল্য। এ জন্য সরকার ‘ম্যানডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট-২০১০’ বাস্তবায়ন করছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেই প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটি টাকার পাটের বস্তার অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।

২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বর্তমান সরকার পাট ও পাটপণ্যের ব্যবহার বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ জন্য পাটের বহুমুখীকরণে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৬৩৬ জন উদ্যোক্তা তৈরি করেছে। জেডিপিসি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তারা ২৩২ ধরনের পাটজাত পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করছে। কারো কারো মতে, প্রচলিত পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পাটকে ঢেউটিনও ফার্নিচার তৈরির উপযুক্ত করতে হবে। পাট থেকে পলিথিন উৎপাদিত হচ্ছে। ভিসকস তৈরির কারখানা করা হচ্ছে। এ ধরনের বড় বড় উদ্যোগ না নিলে পাট দিয়ে বিশ্ব জয় করা সম্ভব হবে না। তবে সবার আগে পাটবীজ নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ পাটবীজের চাহিদার শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ পূরণ করা হয় ভারত থেকে আমদানি করে। সোনালি আঁশের সোনালি ভবিষ্যৎ ফিরে পেতে হলে পাটবীজ উৎপাদনে আমাদের অবশ্যই স্বনির্ভর হতে হবে।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist